বাড়ি কেন সেন্টমার্টিন, মাদক কেন আনলাম না’

বিডি প্রতিদিন •

জয়নাল হোসেন। ৩৫ বছরের এই ব্যক্তির বাড়ি সেন্টামার্টিন ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়ায়। চার দিন আগে তিনি বাড়ি ছাড়েন মাগুরায় এক বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছাতে। কিন্তু পথে দুই দফা পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়েন তিনি। জয়নালের অভিযোগ, গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই পুলিশ নির্যাতন করে তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। ব্যাপক হয়রানি ও নির্যাতনের কারণে তিনি মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

অথচ তিনি কোনো অপরাধ করেননি। শুধু বাড়ি সেন্টমার্টিন ও কাছে মাদক না থাকায় দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। এ ঘটনায় সুষ্ঠু বিচারের দাবি উঠেছে। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলছেন, পুলিশের হাতে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে তার এলাকার লোকজন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যেতেও ভয় পায়। জয়নালের অভিযোগ খতিয়ে দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে চট্টগ্রামের পুলিশ।

জয়নাল জানান, গত ১২ জুলাই বুধবার ৩ ঘণ্টা সাগর পাড়ি দিয়ে বিকাল ৫টার দিকে টেকনাফ থেকে ঢাকাগামী ইম্পেরিয়াল এক্সপ্রেস (ঢাকা মেট্রো ১৩২২০৯) বাসে চড়েন তিনি। পথমধ্যে রাত ১টার দিকে চিটাগাং নতুন ব্রিজ এলাকায় পুলিশ চেক পোস্টে বাসটিকে দাঁড় করানো হয়। গাড়িতে উঠে পুলিশ কয়েকজন যাত্রীকে তাদের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে। তাদের মধ্যে জয়নাল সেন্টমার্টিন বলায় তাকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেখাতে বলা হয়। এনআইডি দেখার পর তাকে গাড়ি থেকে নেমে আসার কথা জানানো হয়। যাত্রীদের থেকে আলাদা করার পর তার ব্যাগ ও দেহ তল্লাশি করা হয়। কিন্তু কিছু না পেয়ে ক্লিনিকে নিয়ে পেট এক্সরে করে দেখতে চায় পুলিশ সদস্যরা।

সে সময় গাড়ির যাত্রী ও সুপারভাইজার পুলিশকে জানায়, এই যাত্রীসহ আরও কয়েকজনকে পথে পাঁচবার তল্লশি করা হয়েছে। পুলিশ কোনো কথায় কান না দিয়ে গাড়ির চালককে অপেক্ষা করতে বলে জয়নালকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠিয়ে নিয়ে ক্লিনিকে যায়।

ক্লিনিকে পৌঁছানোর পথে পুলিশ জয়নালকে বলে, ‘তোমার কাছে যাই থাক, আমরা কোনো কিছু দেখব না। আমাদের ২০ হাজার টাকা দিলে তোমাকে নিরাপদে গাড়িতে তুলে দেব।’ জয়নাল পুলিশের এই কথা শুনে কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, ‘আমাকে যেমন ইচ্ছা পরীক্ষা করেন। কিন্তু আপনারা কোনো কিছু দিয়ে ফাঁসিয়ে আমার জীবন ও পরিবার নষ্ট করবেন না।’ জয়নালের এই করুণ আহ্বানে তাদের মন গলেনি। ক্লিনিকে এক্সরে করে কিছু না পাওয়াই শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন।

এক পর্যায়ে পুলিশ জয়নালের কাছে ৫ হাজার টাকা দাবি করে। তার কাছে থাকা ৪ হাজার ৬০০ টাকার মধ্যে পুলিশ ৪ হাজার টাকা ও ৫ কেজি শুটকি মাছ ছিনিয়ে নেয়। জয়নাল দিতে না চাইলে, পুলিশ ইয়াবা দেখিয়ে বলে-‘এই মাদক দিয়ে তোকে চালান করা হবে।’ শুধু তাই নয় পুলিশ আরও বলে, ‘গাড়িতে যাত্রীদের কাছে এই বিষয়ে মুখ খুললে সীতাকুণ্ডু পার হয়ে পুলিশ চেক পোস্টে নামিয়ে গুম করা হবে।’ শর্ত দিয়ে মোবাইলের থাকা সব মোবাইল নাম্বার মুছে দিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকা ইম্পেরিয়াল এক্সপ্রেস বাসে তুলে দেয় জয়নালকে। অশিক্ষিত জয়নালের কোনো ফোন নাম্বার স্মরণ করে রাখেননি। তাই তিনি অপেক্ষায় থাকেন কখন পরিবারের সদস্যরা তাকে ফোন করবেন।

সকাল সাড়ে সাতটায় ঢাকার সায়দাবাদে বাস থেকে নামতেই দ্বিতীবার জয়নাল পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়ে। সেখানে তার কাছ থেকে পুলিশ ৬০০ টাকা নিয়ে নেয় এবং মাদক দিয়ে চালান দেওয়ার হুমকি দিয়ে ছেড়ে দেয়। নিরূপায় জয়নাল মনের কষ্টে সায়দাবাদ রেললাইন ধরে হেঁটে কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছান। কাছে টাকা না থাকায় অনাহারে বৃহস্পতিবার সারা দিন ও রাত পার করতে হয় তাকে।

শুক্রবার সকালে জয়নালের মনে সন্দেহ তৈরি হয়। তিনি ভাবতে থাকেন পুলিশ তার ফোনে কোন সমস্যা করেছে। কমলাপুর রেলস্টেশনের বাইরে চায়ের দোকানদার দুলাল তার কথা শুনে মোবাইটি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিছুক্ষণ পর দুলাল জানান, ফোনের সব নাম্বার মুছে দেওয়ার আগে সেগুলো ব্লাকলিস্টে রাখা হয়েছে। দুলাল ব্লাকলিস্ট ক্যানসেল করার কিছু সময়ের মধ্যে জয়নালের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ হয়। বিকাশে টাকা এলে কিছু খেয়ে মাগুরার দিকে রওনা হন তিনি।

শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জয়নাল এতটাই ক্লান্ত ছিলেন যে তিনি বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। বাসের সুপারভাইজার ঘুম ভাঙালে জয়নাল দেখেন তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলায় এসে পড়েছেন। জয়নাল সেখানে রাত কাটিয়ে শনিবার দুপুরে মাগুরা স্টেডিয়াম গেটে বাস থেকে নামেন।

জয়নালের বাবা রশিদ আহম্মদ ফোনে বলেন, ‘খারাপ মানুষ পথচারীদের সব কেড়ে নেয় তাই জানতাম। কিন্তু পুলিশ দুই জায়গায় দুবার আমার ছেলের কাছ থেকে তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি এই কাজ করে তাহলে মানুষ বিচার পাবে কার কাছে? তদন্ত করে ব্যাবস্থা নিলে টেকনাফ উপজেলার মানুষদের, কথিত মাদকের নামে পুলিশের কাছে সর্বস্ব হারাতে হবে না।’

টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, ‘এই দ্বীপের মানুষ তার আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারে না পুলিশের ভয়ে। সবার একটাই ধারনা-না জানি পুলিশ কিসের মধ্যে ফাঁসিযে দেয়।

ইম্পেরিয়াল এক্সপ্রেসের সুপারভাইজার মো. সাজ্জাদ বলেন, ‘১২ তারিখ রাতে সেন্টমার্টিনের একজন যাত্রীকে পুলিশ তল্লশির নামে বাস থেকে নামিয়ে নেয়। আমরা এই যাত্রীর জন্য রাস্তায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি।’

চট্টগ্রাম কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল মাহমুদ ফোনে বলেন, যাত্রীদের হয়রানি করলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে ঘটনাটি পর্যালোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেব।

আরও খবর