বাংলা ট্রিবিউন •
কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকা থেকে ইয়াবা, হেরোইন এবং আইসের মতো মাদকদ্রব্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদক কারবারিরা। মাদক পরিবহনে তারা ব্যবহার করছে সড়ক, নৌ এবং আকাশপথ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে তারা নিচ্ছে অভিনব পন্থা। এমনকি নিজেদের মধ্যে গঠন করছে ‘অ্যাডভান্স টিম’; যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারির তথ্য সংগ্রহ করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক ব্যবসায়ীরা ছদ্মবেশে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় আগে থেকেই থাকে অগ্রবর্তী টিম। তারা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ক্লিয়ারেন্স দিলেই মাদক নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে রওনা হয় ক্যারিয়াররা।
কখনও চা বিক্রেতার ছলে, আবার কখনও মোটরসাইকেল ট্রাভেলারের ছদ্মবেশে এমনকি নৌপথে লঞ্চে বিভিন্ন ফেরি-পণ্য বিক্রির ছলে রাজধানীতে নিয়ে আসা হচ্ছে মাদক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে বিভিন্নভাবে রাজধানীতে নিয়ে আসা হচ্ছে ইয়াবা এবং আইসের চালান। এসব মাদক আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদেরকেও; যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বিভিন্ন সময় ইয়াবা এবং আইসের চালান ধরা পড়লেও অনেক চালান থেকে যায় অধরা।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অভিযানে মাদকসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানতে পারেন, নানা কৌশল অবলম্বন করে রাজধানীতে নিয়ে আসা হচ্ছে ইয়াবা আইস হেরোইনের মতো মাদক। পরবর্তী সময়ে রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজার টেকনাফ এবং চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়তায় বিভিন্ন হোটেলে এসব মাদক মজুত করে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে ক্যারিয়ার এবং মাদক ব্যবসায়ীদের পারস্পরিক সহযোগিতায় বিভিন্ন ডিলার এবং বিভিন্ন লোকজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, ‘কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ইয়াবা ও আইস সংগ্রহ করে মাদক কারবারীরা প্রথমে বান্দরবান হয়ে রাঙামাটি নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা হয়ে লোকাল বাসে করে ধাপে ধাপে ফেনী পর্যন্ত আসছে ক্যারিয়াররা। আর এসব ক্যারিয়ারের আগে সড়কের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা দেখানোর জন্য লোকজন নিয়োগ করা থাকে তারা ক্লিয়ারেন্স দিলে পরবর্তীতে সেসব সড়ক দিয়ে যাত্রী সেজে এবং বিভিন্ন ছদ্মবেশে মাদক রাজধানীতে নিয়ে আসছে। মাদক পাচার চক্রের সদস্যরা রাজধানী আশেপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে সেসব বাসায় এনে মাদক মজুত করছে। পরে সময় সুযোগ বুঝে রংপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখছেন কর্মকর্তারা।
বিশেষ করে সড়ক পথে মাদক আনা-নেওয়ার জন্য বিভিন্ন গণপরিবহনগুলোকে টার্গেট করে চালক এবং হেলপারদের বিভিন্ন লোভনীয় অফার দিয়েও নিজেদের দলে বেড়াচ্ছে মাদক কারবারীরা। মাদকের প্রতিটি চালান কক্সবাজার টেকনাফ এলাকা থেকে রাজধানীতে পৌঁছে দিলেই এক একজন পেয়ে যাচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আর এই টাকার হাতছানিতে বিভিন্ন পরিবহনের চালক এবং হেলপাররা গাড়ির বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রেখে ইয়াবা রাজধানীতে নিয়ে আসছে।
সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে রাজধানীর গুলশান ও বনানী এলাকা থেকে কক্সবাজারের কলাতলীতে মেরিন ইকো রিসোর্টের মালিক কাজী জাফর সাদেক রাজুকে (৩৮) গ্রেফতার করা হয়। তার রিসোর্টে মজুত রাখা হতো ইয়াবা। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে রাজধানীতে নিয়ে আসা হতো।
গত ১০ জুলাই কক্সবাজার বিমানবন্দরে ঢাকা আসার পথে এক যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশি করে ৯ হাজার পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। এ সময় ডিস ব্যবসায়ী হিসেবে নুরুল আইয়ুব নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলেও এসব ইয়াবার গন্তব্য কোথায় ছিল এ বিষয়ে এখনও স্পষ্ট ধারণা পায়নি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
১৩ জুলাই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে ৪১ হাজার পিস ইয়াবাসহ ৫ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ঢাকা মেট্রো উত্তর। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কর্মকর্তারা জানায়, মাদক বা ইয়াবা লেনদেনের আগেই মাদক ব্যবসায়ীদের ৪ থেকে ৫ জনের একটি দল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সড়ক পথে বা নৌপথে তৎপর রয়েছে কিনা এসব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে। পরবর্তীতে তাদের ক্লিয়ারেন্সের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে মাদক নিয়ে যাওয়া হয় এবং পৌঁছে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট জায়গায়।
র্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন মাদক মামলার আসামি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে এমন আসামিও আত্মগোপনে থেকে এখনও মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব অপরাধীদের ডাটাবেজ চেক করে আসামিদের বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যখনই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তখনই তাদের তথ্য পর্যালোচনা করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি দেখা গেছে— মোটরসাইকেলে ট্রাভেলারের ছদ্মবেশে, লাগেজের ভেতর চেম্বার করে, সাবানের কার্টুনের ভেতর সাবানের প্যাকেটের ভেতর, গরুর খাদ্যের ট্রাকে, পিকআপ ভ্যানের সামনে প্লাস্টিকের বোতলে বেঁধে, শপিং ব্যাগের ভেতর হলুদের গুঁড়ার প্যাকেটের ভেতরে ভরে, প্রাইভেটকারে তেলের ট্যাংকিতে, জুতার বাক্সের ভেতর, ট্রাকের স্পেয়ার চাকায় লুকিয়ে এবং নারীদের পোশাকের ভেতরে বিশেষভাবে সেলাই করে ইয়াবা পাচারে সক্রিয় কারবারিরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মজিবুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা ছদ্মবেশে যে কৌশল অবলম্বন করছে আমরা সেসব কৌশলের সূত্র ধরে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছি। সম্প্রতি দেখতে পেয়েছি সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে মাদক রাজধানীতে আনা-নেওয়ার সাথে সক্রিয় মাদক কারবারিরা। যদিও তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হচ্ছি আমরা। নৌপথে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আনার জন্য লঞ্চ ব্যবহার করছে। সড়কপথে গণপরিবহনের পাশাপাশি প্রাইভেটকার এবং মোটরসাইকেলে করেও যাত্রীবেশে মাদক আনা নেওয়ার বিষয়টি দেখা হচ্ছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-