আরসার বিরোধে বাড়ছে খুনোখুনি

ক্যাম্প কমান্ডারদের সঙ্গে ‘চুক্তি’ মাদক- চোরাচালান চক্রের: সক্রিয় ১১ সশস্ত্র গ্রুপ

সাহাদাত হোসেন পরশ ও আব্দুর রহমান, সমকাল :

  • যৌথ অপারেশনে সমাধান খুঁজছে প্রশাসন

  • ক্যাম্পে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলতে দেওয়া হবে না- এপিবিএন

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ। তাদের মধ্যে মাদক, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায়ই ঘটছে খুনোখুনি। অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় সাধারণ মানুষও আতঙ্কিত। মুক্তিপণ দিয়েও স্বজনদের বাঁচাতে না পারার একাধিক নজির রয়েছে।

ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আর্থিক সুবিধা দিয়ে মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর কমান্ডারদের সঙ্গে অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে দেশে নেশাদ্রব্যের পাশাপাশি চোরাই পণ্য আনছে মাদক ও চোরাকারবারিরা। এমন বাস্তবতায় যৌথ অপারেশনে সমাধান খুঁজছে প্রশাসন।

জানতে চাইলে ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘যৌথ অপারেশন পরিস্থিতি বিবেচনায় করা হয়। এখন এ ধরনের একটি অপারেশন চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ক্যাম্পে অপরাধীদের শনাক্ত করে ধরা বেশ কঠিন। একই কারণে সোর্সের মাধ্যমে অপরাধীদের সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য পাওয়াও জটিল।’

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র রয়েছে। তাদের পক্ষে আবার ছোট ছোট গ্রুপ কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।’

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের আরাকান স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) ১১টি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সক্রিয় অবস্থানের কথা জানানো হয়েছে।

তাদের মধ্যে উখিয়া, বালুখালী, পালংখালী ও হোয়াইক্যংয়ে আরসা এবং উখিয়া ও পালংখালী ক্যাম্পে সক্রিয় আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। হোয়াইক্যং ক্যাম্পে ‘ইসলামী মাহাজ’ ও ‘জাবু ডাকাত’ নামে দুটি সংগঠন, উখিয়া ও পালংখালীতে মাস্টার মুন্নার দল, নয়াপাড়া ক্যাম্পে চাকমা দল, নবী হোসেন, পুতিয়া, জাকির, সালমান শাহ ও খালেকের নামে ভিন্ন ভিন্ন ডাকাত দল সক্রিয়। সূত্র জানায়, মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে মাদক কারবারি ও অন্যান্য অপরাধ চক্রের সদস্যরা ক্যাম্পে নিজের বলয় তৈরি করে। এর পর মাদকসহ চোরাই পণ্য নিরাপদে দেশে আনতে অর্থের বিনিময়ে এসব গ্রুপের সহায়তা নেয় তারা। এভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে মো. সেলিম, মামুনুর রশিদ, মাহমুদুল হাসান, আতাউল্লাহ, খায়রুল আলম, মো. তৈয়ব, নূর কবির, মো. ইউসুফসহ অনেকে।

উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। তাদের মধ্যে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে এসেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুনোখুনি, অপহরণ ও মাদক কারবারের অভিযোগে বিভিন্ন সময় কারাগারে গেলেও, অনেকে জামিনে বেরিয়ে নানা অপরাধে জড়িত হচ্ছে। মাদক কারবারে জড়িত অনেকেই এখন অপহরণ সিন্ডিকেটের সদস্য। তারা অপহৃত ব্যক্তিকে জঙ্গলের পরিবর্তে এখন ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখছে। আর্থিক সুবিধা পেতে এ চক্রে স্থানীয়দের মধ্যেও কেউ কেউ যুক্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

১৯ জুন উখিয়া ক্যাম্পে আরসা ও আরএসওর মধ্যে গোলাগুলিতে রোহিঙ্গা যুবক ইমান হোসেন নিহত হন। আর ১১ জুন উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে ‘সিক্স মার্ডার’ মামলার আসামি আরসার শীর্ষ নেতা সাব্বির আহমেদ ওরফে লালুকে গ্রেপ্তার করে এপিবিএন।

ক্যাম্প-১৮-এর বাসিন্দা রহিম উল্লাহ বলেন, ‘ক্যাম্পের হেড মাঝি ও আরসার মধ্যে দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। মাদক, অপহরণ, গুম, মুক্তিপণের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়েও বিভিন্ন গ্রুপের বিরোধ রয়েছে।’

সূত্রের দাবি, ক্যাম্পে আরসার সদস্যদের মধ্যেও বর্তমানে বিভেদ চরমে। উদ্দেশ্য নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় সংগঠনের প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনির গ্রুপ থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে অন্য একটি অংশ। আর এ অংশকে ভেড়াতে চাইছে আরএসও। এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি।

আরসার গোপনীয়তা প্রকাশের আশঙ্কা ও প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হচ্ছে– এমন আতঙ্কে দলছুট সদস্যদের টাগের্ট করে হত্যা করা হচ্ছে। এভাবে গত দুই মাসে ক্যাম্পগুলোতে ২৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই এক সময় আরসার সদস্য ছিল।

পুলিশ জানায়, মে মাসে উখিয়ার তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার এক শীর্ষ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে বালুখালী ৯ নম্বর ক্যাম্পের সি ব্লকে নুর হাবি ওরফে ডা. ওয়াক্কাস নামে আরসার সক্রিয় কমান্ডারকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন অ্যান্ড মিডিয়া) ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ক্যাম্পে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বাড়ছে খুনোখুনি। কে আরসা, কে আরএসও– সেটি বিষয় নয়। ক্যাম্পে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলবে না। যারাই অপরাধে জড়াবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত এক বছরে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ৩৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ও ১৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। একই সময়ে ২৬ লাখের বেশি ইয়াবা ও ২৯ কেজি আইসসহ ৭৭৯ জন রোহিঙ্গাকে ধরা হয়। এ ছাড়া ১৩৬ রোহিঙ্গা অপহরণের ঘটনায় ১৮ মামলায় ২৯ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আরও খবর