অন্ধকারে আলোচিত তিন মাদক মামলার তদন্ত

ইন্দ্রজিৎ সরকার, সমকাল •


অবৈধ মাদক উদ্ধারের ঘটনায় করা আলোচিত তিন মামলার তদন্ত দীর্ঘদিন কার্যত স্থবির হয়ে আছে। এগুলোর কোনোটি সাড়ে তিন বছর, আবার কোনোটি পৌনে তিন বছর ঝুলে আছে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয়েছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তাঁর ভাতিজার বাসায় অভিযানের ঘটনায়। তৃতীয় মামলাটি গুলশানের হর্স অ্যান্ড হর্স পার্টি মেরি রেস্তোরাঁ থেকে মাদক উদ্ধারের।

ডিএনসি সূত্র বলছে, মামলাগুলোর তদন্ত আরও আগেই গুছিয়ে আনা হয়েছে। জব্দ করা নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষায় মিলেছে মাদক। তবে মাদকের নেপথ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তি থাকায় বা তাদের ঘনিষ্ঠরা আসামি হওয়ায় অভিযোগপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।

ডিএনসির অতিরিক্ত মহাপরিচালক আজিজুল ইসলাম বলেন, আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তাঁর ভাতিজার বাসায় অভিযানের মামলা দুটি ডিএনসি মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কার্যালয়ের অধীনে তদন্ত চলছে। আর তৃতীয়টির ব্যাপারে সম্প্রতি আদালত থেকে স্থিতাবস্থা জারি করা হয়েছে।

২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর গুলশান ২ নম্বর সেকশনের ৫৭ নম্বর সড়কে পাশপাশি দুটি ভবনে অভিযান চালায় ডিএনসি। এর একটি আজিজ মোহাম্মদ এবং অপরটি তাঁর ভাতিজা ওমর মোহাম্মদের বাসা। এর মধ্যে ওমরের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট ও ভবনের ছাদে বিলাসবহুল ঘর তৈরি করে মাদকের আড্ডা চালানো হচ্ছিল। ছিল মদ ও সিসার মজুত। অভিযানে আট বোতল বিদেশি মদ, ২৪ ক্যান বিয়ার, ৩ কেজি সিসা ও ২০০ গ্রাম গাঁজা জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় ডিএনসির উপপরিদর্শক আতাউর রহমান গুলশান থানায় মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় পলাতক ওমর মোহাম্মদকে।

অপরদিকে আজিজ মোহাম্মদের বাসা এবং তাঁর গুলশান-১ নম্বরের ফ্ল্যাটেও অভিযান চালিয়ে প্রচুর বিদেশি মদ, বিয়ার, সিসা ও ক্যাসিনো সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। তখন আজিজের দুই কর্মচারী মো. পারভেজ ও নবীন মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। তদন্তে মাদক রাখার ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তারপর গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও আলোচিত এই দুটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মামলা দুটির তদন্তে ঘুরেফিরে আজিজ মোহাম্মদের নাম চলে আসে। কিন্তু অভিযোগপত্রে তাঁর নাম উল্লেখ করা হবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ ছাড়া তাঁর নাম না দেওয়ার জন্য প্রভাবশালী মহলের চাপও রয়েছে। এসব কারণেই অভিযোগপত্র দিতে দেরি হচ্ছে।

মামলার হদিস জানে না কেউ

আজিজ মোহাম্মদের বাসায় অভিযানের মামলাটি এখন ডিএনসির কোন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে রয়েছে তা সংস্থার কেউ বলতে পারেননি। বিষয়টি জানতে ডিএনসির পরিদর্শক থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ ১০ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে সমকাল। তাঁরা কেউ নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেননি। কেউ বলেছেন মামলাটি মহানগর উত্তর, আবার কেউ বলেছেন দক্ষিণ কার্যালয়ের অধীনে।

অবশ্য তাঁরা এটা নিশ্চিত করেছেন, মামলাটির তদন্ত এখনও চলছে। ডিএনসি মহানগর দক্ষিণের উপপরিচালক মাসুদ হোসেন বলেন, এটা আমার দায়িত্ব নেওয়ার আগের সময়ের মামলা। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এটি দেখাশোনা করছেন। মামলাটি দক্ষিণ বিভাগের মতিঝিল সার্কেল তদন্ত করছে।

তবে মতিঝিল সার্কেলের পরিদর্শক মিজানুর রহমান বলেন, মামলাটি সম্ভবত ধানমন্ডি সার্কেলে রয়েছে।

ডিএনসির ধানমন্ডি সার্কেলের পরিদর্শক তপন কান্তি শর্মা জানান, ওই মামলা তাঁর কাছে নেই। তবে ওমর মোহাম্মদের বাসায় অভিযানের ঘটনার মামলাটি তিনি তদন্ত করছেন। পলাতক ওমর যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে জন্য ইমিগ্রেশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিকানাসহ আরও কিছু বিষয় খতিয়ে দেখার আছে। ফলে তদন্ত শেষ করতে সময় লাগছে।

এদিকে আজিজ মোহাম্মদের বাসায় অভিযানের মামলাটি এর আগে তদন্ত করেন সবুজবাগ সার্কেলের পরিদর্শক ইব্রাহিম খান। বর্তমানে তিনি বগুড়ায় কর্মরত। তিনি জানান, দেড় বছর আগে তদন্তভার হস্তান্তর করে নতুন কর্মস্থলে যান। তাঁর তদন্তকালেই জব্দ করা নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষায় মাদকের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়। গ্রেপ্তার দু’জনের সংশ্লিষ্টতারও প্রমাণ পাওয়া যায়।

এর আগে মামলাটির তথ্যের জন্য ডিএনসি মহানগর দক্ষিণ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুব্রত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংস্থার পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কিন্তু সুব্রত সরকার হজ পালনের উদ্দেশে সৌদি আরবে থাকায় নথি না দেখে এ ব্যাপারে কথা বলতে পারবেন না বলে জানান। তিনি ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জাফরুল্লাহ কাজলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। অবশ্য অতিরিক্ত মহাপরিচালকও এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পৌনে তিন বছরেও শেষ হয়নি তদন্ত

২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গুলশানের হর্স অ্যান্ড হর্স পার্টি মেরি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে ২০৩ বোতল বিদেশি মদ, ৮১০ ক্যান বিয়ার, দুই কেজি সিসা ও তিনটি হুক্কা জব্দ করে ডিএনসি। অভিযানের পর ডিএনসির পক্ষ থেকে বলা হয়, অনুমোদন ছাড়াই মদ, বিয়ার, সিসা বিক্রি করছিল প্রতিষ্ঠানটি। এ ঘটনায় গুলশান থানায় করা মামলাটির সময়সীমা কয়েক দফায় বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে প্রায় পৌনে তিন বছরেও তদন্ত শেষ হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিযানের সময় দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মামলার এক নম্বর আসামি মেহরীন সারা মনসুর পলাতক। পরে জানা যায়, তাঁর সঙ্গে ব্যবসায়ী শফিউল্লাহ আল মুনিরের চুক্তি ছিল। জব্দ করা মদ, বিয়ার, সিসা তিনিই সরবরাহ করেছিলেন। বনানী থানার একটি মামলায় মুনির কারাগারে ছিলেন। তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় এই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, হর্স অ্যান্ড হর্স পার্টি মেরি রেস্তোরাঁর মালিক প্রভাবশালী এবং শীর্ষ এক রাজনৈতিক নেতা ও শিল্পপতির ঘনিষ্ঠজন। এ কারণে অপরাধের প্রমাণ নিশ্চিত হওয়ার পরও তদন্তে গতি আসেনি। বিভিন্ন সময়ে তদন্তে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগও রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ মামলাটিতে ছয় মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন আদালত। এখন এটাকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও এর আগের আড়াই বছরেও মামলাটি ঝুলেই ছিল।

ডিএনসি মহানগর উত্তরের উপপরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, তিন মামলার মধ্যে দুটির আসামি এখনও পলাতক। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। অপর মামলাটির তদন্ত এখনও শেষ করা যায়নি।

আরও খবর