সাইফুল ইসলাম, মৌলভীবাজার •
গত ২২ মাসে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় আটক হয়েছেন ৯৪ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী।
সবশেষ গত ৬ জুন জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী চাম্পারায় চা বাগান থেকে ২ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আটক করে বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন (বিজিবি)। ধরা পড়া রোহিঙ্গা সদস্যদের বরাত দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতে যেতে কিংবা সেখান থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার উদ্দেশ্যে সীমান্তে এসে আটক হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায়শই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এমন রোহিঙ্গা শরণার্থী ধরা পড়ছেন। এদিকে এমন ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, মৌলভীবাজারের সীমান্ত এলাকা কি তাহলে রোহিঙ্গা পাচারের ট্রানজিট রুট?
গত ৬ জুন দুই রোহিঙ্গা আটকের আগেও ১৩ মে দুপুরে মৌলভীবাজার দিয়ে ভারতে পালানোর সময় সদর উপজেলার শ্যামেরকোনা বাজারে তিন রোহিঙ্গাকে আটক করে স্থানীয়রা। পরে তাদের তুলে দেওয়া হয় থানা পুলিশের কাছে।
এরও আগে ২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ এনা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে ১৬ রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করে। একই দিনে ভোর ৬টায় জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের লাঠিটিলা এলাকার নালাপুঞ্জি থেকে শরীফ হোসেন নামে এক রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ।
তার ঠিক তিন দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের কচুরগুল নালাপুঞ্জি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ৯ জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয়রা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা পুলিশকে জানিয়েছিল, তারা আট জন রোহিঙ্গা ও এক জন বাংলাদেশি নাগরিক। রোহিঙ্গারা ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে মৌলভীবাজার আসেন। সেখানে দালালের পাঠানো সিএনজি গাড়িযোগে তারা জুড়ীর সীমান্ত এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে সুমন নামে এক দালালের বাড়িতে তারা অবস্থান নেয়। রাত সোয়া ৯টায় লঙ্গরখানা এফআইভিডিবি বিদ্যালয় সংলগ্ন সীমান্ত দিয়ে তারা ভারতে প্রবেশ করে। ভারতীয় সীমান্তে অপেক্ষমাণ অপর দুই দালাল তাদের দিল্লিতে পাঠানোর উদ্দেশ্যে একটি বাসে ওঠায়। তবে বাসে ওঠার পরপরই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং গভীর রাতে নালাপুঞ্জি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশব্যাক করে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট ভারতে যাওয়ার সময় মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের কুমারশাইল সীমান্ত এলাকা থেকে আটক হন সাত রোহিঙ্গা। তারা দালালের মাধ্যমে ভারতে যাওয়ার জন্য কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং থ্যাংখালী (এফডিএমএন) ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বড়লেখায় এসেছিলেন। ১১ জুন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের কুমারশাইল সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারত প্রবেশের চেষ্টাকালে পুলিশ এক তরুণীসহ ৫ রোহিঙ্গাকে আটক করে। তারা কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পালিয়েছিলেন। ১২ মে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মৌলভীবাজার শহরের ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঘোরাফেরা করা অবস্থায় চার নারী, তিন পুরুষ ও ১১ রোহিঙ্গা শিশুসহ মোট ১৮ জনকে আটক করে মৌলভীবাজার মডেল থানা পুলিশ।
২০২১ সালের ১৭ জুলাই মৌলভীবাজার শহরের শ্রীমঙ্গল সড়কের মৌলভীবাজার-ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে শিশু, নারী ও পুরুষসহ ২১ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আটক করে মৌলভীবাজার মডেল থানা পুলিশ। তারা কুলাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে পুলিশকে জানায়। ওই বছরের ২ জুলাই মৌলভীবাজার শহরের চুবরা এলাকা থেকে ১৪ রোহিঙ্গাকে আটক করে মৌলভীবাজার মডেল থানা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছিলেন, কাজের সন্ধানে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী শরণার্থী শিবির থেকে এসেছিলেন তারা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) জাতীয় পরিষদ সদস্য আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। ক্যাম্পের বাইরে আসা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। এ ইস্যু কোনোভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। রোহিঙ্গারা কীভাবে এবং কার ছত্রচ্ছায়ায় মৌলভীবাজারে আসে, তা খতিয়ে দেখার দাবি জানাচ্ছি।’
রোহিঙ্গারা যে সুযোগ পাচ্ছে, তাতে সমাজে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আমাদের সরকারের আলোচনা দরকার। তাদের ব্যাপারে সরকারের উচ্চমহলের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। নতুবা একটা সময় তারা আমাদের দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে বলে আমার ধারণা।’
মৌলভীবাজার জজ আদালতের সহকারী সরকারি কৌশলী (এজিপি) অ্যাডভোকেট জাহিদুল হক কচি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যে মৌলভীবাজারে আসে তা হলো ক্রিমিনাল অ্যাক্ট। ঘন ঘন মৌলভীবাজারে তাদের আগমন আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ পারিপার্শ্বিকতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং অপরাধ প্রবণতা বাড়বে। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির উচিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নজরে নেওয়া।’
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘২০১৭-১৮ সালে যখন বড় ঘটনাটা ঘটে তখন মিয়ানমার থেকে অনেক রোহিঙ্গা সরাসরি বাংলাদেশের কক্সবাজারে চলে আসেন। এছাড়া কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারের উত্তরপাড় দিয়ে ত্রিপুরা হয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে ক্যাম্প থেকে কৌশলে পালিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে সেখান থেকে চোরাপথে চলে গিয়েছিল ভারতে।’
ওই সময়ে যারা ভারতে গেছেন, দেশটির সরকার তাদের আধার কার্ড এবং লোকাল পারমিটও দিয়েছিল। তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের কল্যাণ বেশি। বিভিন্ন কারণে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ক্যাম্পে আসার একটা প্রবণতা আছে বলেও উল্লেখ করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘বিজিবি অবৈধ অনুপ্রবেশের সময় তাদের ধরে আমাদের কাছে হস্তান্তর করে। আমরা তাদের সরাসরি প্রটোকল অনুযায়ী কুতুপালং ক্যাম্পে ফেরত দেই। আর কিছু অবৈধভাবে ঢোকার চেষ্টা করে, তখন যারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে; তাদেরও আমরা ঢাকায় পুলিশের বিশেষ শাখার সঙ্গে কথা বলে কুতুপালং ক্যাম্পে ফেরত দেই।’
বাংলাদেশে কীভাবে অবৈধভাবে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করেন, জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘জেলার কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা এলাকার কিছু স্থানীয় লোক এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। আমরা কয়েকটি নামও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা তাদের এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারিনি। আমরা সতর্ক আছি।’
সীমান্ত দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা ঢুকে যাচ্ছেন, এমনটা নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে কয়েকজন ঢোকেন, তাদের বেশিরভাগই ধরা পড়ে। আমরা তাদের ক্যাম্পে ফেরত দেই।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-