সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার •
কক্সবাজারের সর্বত্র সুপেয় পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। জেলা শহরসহ ৯ উপজেলার ৭২ ইউনিয়নের সিংহভাগ এলাকাতেই ক্রমে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। জেলার সরকারি প্রায় ৩১ হাজার নলকূপের সোয়া ১ হাজার অকেজো হয়ে পড়েছে। পানি উঠছে না আরো হাজারখানেক নলকূপে। উপকূল-সমতলে সংকট একই ধরনের। ভোগান্তি বেড়েছে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পেও।
অনাবৃষ্টি ও বাড়তি তাপমাত্রায় এই ভোগান্তি বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। সদরসহ উপজেলা শহরে গাড়িতে করে কিছু এলাকায় খাওয়ার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সারফেস ওয়াটারের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে এই সংকট আরো বাড়তে পারে বলে অভিমত তার।
কক্সবাজার পৌরসভা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের মতে, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ ফুট হারে নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও শহরের টেকপাড়ায় ১২০ থেকে ১৫০ ফুটের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাওয়া যেত। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ৩০০ ফুটের বেশি গভীরে। গত কয়েক বছরে কক্সবাজার সাগরপাড়ের কলাতলী এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমেছে। ফলে অকেজো হয়েছে সাগরপাড়ের তিন শতাধিক আবাসিক হোটেলের অসংখ্য পানির পাম্প। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এমন অবস্থা বলে মনে করছে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা এবং যত্রতত্রভাবে পুকুর-খাল-বিল ভরাটের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সামনে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।
জানা গেছে, কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণত মাটির নিচে ৩০-৩৫ ফুট গভীরে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু কিছু এলাকায় পানির স্তর ৫০ থেকে ৬০ ফুটে নেমে গেছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ঐ সব এলাকায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়ছে। এতে গৃহস্থালি কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। বোরো চাষে পানির সংকটের আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, গ্রীষ্ম শুরু হতে না হতেই এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ টিউবওয়েল থেকে পানি উঠছে না। শহরে পানি কিনে পানের সুযোগ থাকলেও গ্রামে সুপেয় পানির জন্য নলকূপই ভরসা। গ্রামের অনেককেই পানযোগ্য এক কলসি পানি আনতে অনেক দূর যেতে হচ্ছে। তার পরই মিলছে পানি। আর যারা দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিতে পারছেন না, তাদের টাকার বিনিময়ে কিনতে হচ্ছে খাওয়ার পানি।
কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া কোনারপাড়ার সাইফুল ইসলাম বলেন, পক্ষকাল ধরে তাদের মোটরে পানি উঠছে না। এতে তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। একই অবস্থা তাদের আশপাশেও। অথচ তাদের বাড়ি থেকে দেড় শ গজ দূরত্বে বয়ে চলেছে কক্সবাজারের মিঠাপানির আধার বাঁকখালী নদী।
সুপেয় পানির সমস্যা ঈদগাঁওয়ের ভাদিতলা, কলেজগেট, পালাকাটা, নতুনমহাল, চৌফলদণ্ডী, পোকখালী, গোমাতলী, জালালাবাদ, ইসলামপুর, ইসলামাবাদসহ টেকনাফ, উখিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী, রামু ও কুতুবদিয়ার বিভিন্ন এলাকায়।
কুতুবদিয়ার সমাজকর্মী হাসান মাহমুদ সুজন বলেন, উপজেলার উত্তর ধূরুং, দক্ষিণ ধূরুং, লেমশীখালী, কৈয়ারবিলসহ বড়ঘোপ ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকায় হস্তচালিত টিউবওয়েল থেকে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
টেকনাফের পরিবেশকর্মী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পৌরসভার কায়ুখালীপাড়া, চৌধুরীপাড়া, বাস স্টেশন, পল্লানপাড়া, নাইট্যংপাড়ার লোকজন পাহাড়ি ঝরনার পানি সংগ্রহ করে চাহিদা মেটাচ্ছে।
কক্সবাজারের প্রকৃতি ও প্রাণী গবেষক আহমেদ গিয়াস বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুকুর-লেক বা নদীর পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক জরিপে বলা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা না হলে প্রতি বছর ১০ মিটার করে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-