ডেস্ক রিপোর্ট •
রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি সাহায্য কমিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা। রোহিঙ্গা ঢলের শুরুতে তাদের জন্য ব্যয়ের ৭২ শতাংশ দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। ২০২২ সালে পাওয়া গেছে ৬২ শতাংশ। চলতি বছরে সাহায্যের পরিমাণ আরও কমার শঙ্কা আছে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কর্মসূচি কাটছাঁট করেছে। ফলে তাদের খাদ্য ও অপরাপর মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার দাতাদের জরুরি বৈঠক ডেকেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আগামী ৭ মার্চ বাংলাদেশ সরকার ও রোহিঙ্গাদের সহায়তা কার্যক্রমে জড়িত সংস্থাগুলো নতুন করে সহায়তার আবেদন জানাতে পারে। এ ছাড়াও রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা ধরনের সমস্যার উদ্ভব হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা বাবদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি পরিবারে প্রত্যেককে ১২ ডলার করে সহায়তা দিচ্ছিল। বুধবার থেকে এই সহায়তার পরিমাণ ১০ ডলারে নামিয়ে এনেছে। জাতিসংঘ খাদ্য সংস্থা ডব্লিউএফপি বুধবার থেকে একই সঙ্গে খাদ্য সহায়তা কাটছাঁট করেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এমনিতেই রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে কাজ করছে। এখন সাহায্য কমে যাওয়ায় ক্যাম্পের বাইরে আসার প্রবণতা আরও বাড়বে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বিদেশি সাহায্য কমে যাওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের জন্য সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। বাজেটে ঘাটতি হলে খাবারের অভাব হলে রোহিঙ্গারা বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সে কাজ করতে গিয়ে তারা সস্তা শ্রম বিক্রি করবে। এতে বাংলাদেশের শ্রমিকরা শ্রমবাজার থেকে বাদ পড়বে। একটা চেইন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সহাবস্থান সৃষ্টির চেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা সামাজিক সংকটের সৃষ্টি করবে।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি দাতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সাহায্য ৭২ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে নেমে গেছে। নানাবিধ কারণে সহায়তা কমে গেছে। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় মানবিক সহায়তা দানকারীদের মধ্যে আবেগ কমে যাচ্ছে। আরেকটা কারণ হলো, জাতিসংঘ প্রথমদিকে রোহিঙ্গা সংকটকে লেবেল-তিন ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেছিল। লেভেল-তিন হলো সর্বোচ্চ জরুরি পরিস্থিতি যা বর্তমানে তুরস্কে রয়েছে। লেভেল-তিন জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করলে জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ লোকদের এখানে পাঠানো হয়।
তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন রকমের পদ্ধতি গ্রহণ করে। পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ায় তারা রোহিঙ্গা সংকটকে লেভেল-দুইয়ে নামিয়ে এনেছে। কারণ এই সংকট সহজে সমাধান হচ্ছে না। এই সংকটকে জরুরি অবস্থা নয় বলে ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে অনেক বৈশ্বিক সংকট তৈরি হয়ে গেছে। ইউক্রেন, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, সর্বশেষ তুরস্কে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে। ফোকাস অন্য দিকে চলে গেছে।
জানতে চাইলে কক্সবাজারে অবস্থানরত জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার হেড অব অপারেশনস ইয়োকো আকাসাকা বলেছেন, দাতাদের তহবিল কমে যাওয়ার মানে হলো, গত বছর আমরা যা রোহিঙ্গাদের দিয়েছি, এবার তা দিতে পারব না। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। আমরা ইতোমধ্যে কর্মসূচি কাটছাঁট করেছি। ডব্লিউএফপি কর্মসূচি কাটছাঁট করেছে। সহায়তা কমায় অভ্যন্তরীণ সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আফগানিস্তান, ইউক্রেন ও তুরস্কেও পরিস্থিতির কারণে অগ্রাধিকারে পরিবর্তন হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটকে কিছুতেই ভুলে যাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, তারা তহবিল সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
তারিক আল মাহমুদ কক্সবাজারের উখিয়ায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থাপিত একটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। হাসপাতালটিতে দাঁড়িয়ে একটি বিশেষ পুষ্টিকর খাদ্য দেখিয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের ছয় বছর পর্যন্ত এই প্যাকেটজাত মূল্যবান খাবারটি দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু বাজেট ঘাটতির কারণে এখন দুই বছর পর্যন্ত শিশুর মধ্যে এই প্যাকেট বিতরণ করা হয়। তারপর শিশুদের পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়ানোর জন্য প্রতিমাসে প্যাকেটের বদলে দেওয়া হয় মাত্র তিন ডলার নগদ আর্থিক সহায়তা।
কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে বিদেশি সহায়তায় স্থানীয় বিভিন্ন এনজিও হাসপাতাল স্থাপন করেছে। চার নম্বর ক্যাম্পে স্থাপিত হাসপাতালটি পরিচালনা করছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ক্লিনিক ম্যানেজার ড. আব্দুল কালাম হাসপাতালটির বিভিন্ন শাখা ঘুরে দেখালেন। এখানে আউটডোর, জরুরি বিভাগ, ওয়ার্ড, ডায়াগনসিস সেন্টার, ডিসপেনসারি, অ্যাম্বুলেন্স, পুষ্টি শাখাসহ অত্যাধুনিক চিকিৎসা সেবার সবই রয়েছে। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের বিনামূল্যে সব ধরনের চিকিৎসা ও পুষ্টি সেবা দিয়ে থাকি। তবে বাজেট কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব সহায়তা কাটছাঁট করা হচ্ছে।’
কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত উখিয়া উপজেলা এখন রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারি দপ্তর, দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থা এবং এনজিও কর্মকাণ্ডে সরব। কক্সবাজার জেলা সদর থেকে সড়কপথে উখিয়ায় প্রবেশের সময় রাস্তার পাশে চোখে পড়ে বিদেশি ব্র্যান্ড নর্থ অ্যান্ডের কফি শপ, জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা ডব্লিউএফপি’র তাঁবু টানানো হাব, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির।
২০১৭ সালে মিয়ারমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর দেশটির সামরিক বাহিনী ও কট্টরপন্থি বৌদ্ধরা নিষ্ঠুর নিপীড়ন শুরু করে। তখন তারা আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের সাদরে বরণ করেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ঢেউ বাড়তে থাকলে স্থানীয়রা এক পর্যায়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হন।
রোহিঙ্গারা উখিয়ায় বনউজাড়, পাহাড়কাটা, পরিবেশ ধ্বংস করা শুরু করলে স্থানীয় সাধারণ মানুষের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা প্রাথমিকভাবে মনে করেছিলেন, রোহিঙ্গারা দ্রুতই বিদায় নেবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিজেদের দেশে ফিরে যাবে। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে তাদের প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনগণের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদারভাবে আশ্রয় দেওয়া তাদের জন্য কাল হয়েছে।
বনউজাড় করা বন্ধ করতে সরকার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং এনজিওগুলো বিকল্প খুঁজে বের করছে। প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গাদের রান্নার জন্য বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে সিলিন্ডার ভর্তি এলপিজি গ্যাস। প্রতিমাসে প্রতিটি গৃহস্থালি সিলিন্ডার গ্যাস পাচ্ছে। ঘিঞ্জি রোহিঙ্গা শিবিরে সিলিন্ডার গ্যাস থেকে আগুন লাগার আশঙ্কা থাকলেও এর ব্যবস্থাপনায় যুক্ত এনজিও কর্মকর্তারা বলছেন, যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি নেই :
ট্রিপলআরসি (রিফিউজি, রিলিফ অ্যান্ড রিপাট্রিয়েশন কমিশনার) নামে অধিক পরিচিত মিজানুর রহমান আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। আমরা এ পর্যন্ত সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছি। মিয়ানমার এসব যাচাই করে কিছু তাদের তালিকায় আছে বলে জানিয়েছে। কিছু রোহিঙ্গা সম্পর্কে তাদের তালিকায় নেই বলে জানায়। কিছু সম্পর্কে বলেছে ‘সন্ত্রাসী’। যাদের নাম মিয়ানমারের তালিকায় নেই এবং যারা ‘সন্ত্রাসী’ বলে বলেছে; তালিকাভুক্তরা অনেকে তাদের পরিবারের সদস্য। এখন আত্মীয়কে বাদ দিয়ে রোহিঙ্গা যাবে না। পুরোপুরি ক্লিয়ার হয়েছে সেই সংখ্যা খুব কম।
প্রত্যাবাসন শুরু করতে কী বাধা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের তরফ থেকে কোনো বাধা নেই। বাধা হলো মিয়ানমারে। সমস্যা মিয়ানমারে নিহিত। সমাধানের দায়িত্বও মিয়ানমারের। আমরা হলাম ইনোসেন্ট ভিকটিম। মিয়ানমারে পরিস্থিতি কখনই প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত ছিল না। আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যুদ্ধ চলছে। সরকার উৎখাত করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নিয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-