মিয়ানমার থেকে মাদক আনতে ‘মানুষ বন্ধক’, চলে নির্মম নির্যাতন

আবদুর রহমান •

হাত দুটি দড়ি দিয়ে পেছনে বাঁধা। শিকলে বাঁধা দুই পা। রড-লাঠি দিয়ে বেদম পেটানো হচ্ছে। যাতে চিৎকার করতে না পারে, সেজন্য কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে মুখও। গগনবিদারী আর্তনাদেও কারও কর্ণপাত নেই। বালুতে লুটিয়ে পড়া অবস্থায় দুজন রাখাইন ওই ব্যক্তিকে বেদম পেটাচ্ছে।

মিয়ানমারে রাখাইনদের বন্দিশালায় টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মিঠাপানির ছড়ার আবুল কাশেমের ছেলে জসিম উদ্দিনকে এমন নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। জানা গেছে, মাদক কারবারিরা এখন মিয়ানমারে ‘স্বজন বন্ধক’ রেখে ইয়াবা ও আইসের চালান আনছে। তবে শর্ত অনুযায়ী টাকা পরিশোধ না করলে বন্ধক রাখা ব্যক্তির ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন।

জসিমকে নির্যাতনের ভিডিও এখন স্থানীয় সবার মোবাইল ফোনে। তাকে বন্ধক রেখে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান এনে টাকা পরিশোধ না করে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে এপারের ইয়াবা কারবারিরা। এ জন্যে চার মাস ধরে সে দেশে তার ওপর চলে নির্যাতন। মিয়ানমার থেকে মোবাইল ফোনে জসিম বন্দিশালা থেকে তার ওপর নির্যাতন চালানোর ভিডিও বাংলাদেশে স্বজনসহ বিভিন্ন মানুষের কাছে পাঠিয়ে মুক্ত করতে সহায়তা চান। জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরের শুরুতে টেকনাফ স্থলবন্দরে আসা ট্রলারে করে ইয়াবা কারবারি জকির আহমদ মিয়ানমারে পাঠায় জসিমকে।

সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে এই প্রতিবেদকের কাছে সহায়তা চেয়ে জসিম উদ্দিন বলেছেন, ‘টেকনাফের হাজমপাড়া জকির আহমদ তাকে কাঠের ব্যবসার কথা বলে স্থলবন্দরে আসা ট্রলারে মিয়ানমারে পাঠান। পরে জানতে পারেন কৌশলে জকির তাকে বন্ধক রেখে রাখাইনদের কাছ থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা আনেন। কিন্তু ইয়াবার টাকা না পেয়ে তারা (রাখাইনরা) প্রতিদিন নির্মমভাবে নির্যাতন করছে। ঠিকমতো খাবারও দিচ্ছে না। আমাকে মুক্তি দিতে পরিবারের কাছে ১০ লাখ মুক্তিপণ দাবি করে আসছিল। কিন্তু গত চার মাস ধরে তারা আমার ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে জকিরের স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে টাকা পরিশোধের কথা বললেও তা দেয়নি।’

অনুসন্ধানে সম্প্রতি টেকনাফে ‘মানুষ বন্ধক’ রেখে মাদক আনার বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা জানা গেছে। বাংলাদেশি কারবারিরা সময়মতো টাকা পরিশোধ না করায় বন্ধক ব্যক্তিকে নির্যাতনের ভিডিও পাঠানো হয়েছে। যা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ইয়াবা কারবারিদের এমন কৌশলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মাদক প্রতিরোধে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও।

জসিমের মতো টেকনাফ সদরের পল্লানপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়ানমারে বন্দিশালায় আটকে আছেন। গত দুই মাস আগে একই এলাকার খাইরুদ্দিন তাকে মিয়ানমার পাঠিয়ে এক লাখ ইয়াবা নিয়ে আসে। তার বিনিময়ে আইয়ুবকে মিয়ানমারে বন্ধক রাখে। এ ছাড়া তিন মাস পর মিয়ানমারের বন্দিশালা থেকে মুক্তি পান টেকনাফের সাবরাং বাহারছড়া গ্রামের আলী হোসেন। তাকে বন্ধক রেখে এক লাখ ইয়াবা এনেছেন একই এলাকার শাকের মাঝি। শাকের বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মাহাবুব আলম বলেন, ‘আমার এলাকার আইয়ুব নামে এক যুবক মিয়ানমারে জিম্মি আছেন। পরে জানতে পারি ইয়াবার বিনিময়ে তাকে সে দেশে বন্ধক রাখা হয়। এ ঘটনার জের ধরে এখানে দুই পরিবারের মাঝেও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। মাদক বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযান চালানো দাবি জানাচ্ছি।’

এদিকে, গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারে ইয়াবা কারবারিদের ডেরায় বন্ধক রাখা আরও একজনের নির্যাতনের ভিডিও ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা যায়, নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না করায় বাহারছড়ার বাসিন্দা আলী হোসেনকে শিকলে বেঁধে রড দিয়ে পেটানো হচ্ছে। ভিডিওটি তার পরিবারের কাছে পাঠায় মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, একজন তার গলায় দা ধরে রেখে টাকা পরিশোধের কথা বলছে। টাকা না পেলে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের মহাসচিব বলেন, ‘মানুষ অর্থের প্রয়োজনে জমিজমা বা স্বর্ণালংকার বন্ধক রাখে এটি শুনেছি। কিন্তু এখানে ইয়াবা আনতে মাদককারবারিরা মানুষ বন্ধক রাখছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে সামনে আরও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে।’

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল কক্সবাজারের মাদক কারবারিরা। তবে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর ফের সক্রিয় হয়েছে তারা। কৌশল পাল্টে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার পাশাপাশি আইসের বড় চালান আনছে। এসব মাদক আনতে অনেক সময় অগ্রিম টাকা পাঠায় তারা। মাদকদ্রব্য পাঠাতে মিয়ানমারের কারবারিরা পাচারে যুক্ত ব্যক্তির প্রতিনিধিকেও জিম্মি রাখছে। একইভাবে দেশি কারবারিরাও ইয়াবা-আইস বিক্রির জন্য মানুষ বন্ধক রাখছেন। কারণ হিসেবে কারবারিরা জানায়, আইসের দাম অনেক বেশি। এ জন্য অনেক কারবারি অগ্রিম টাকা পরিশোধ করতে পারে না। তখন তারা সমঝোতার ভিত্তিতে নিজের প্রতিনিধিকে মিয়ানমারে বন্ধক রেখে আসে। এরপর মাদকের চালান নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর পর টাকা লেনদেন শেষ হলে ছাড়া পায় বন্ধকের সেই ব্যক্তি।

এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হালিম বলেন, ‘নির্যাতনের একটি ভিডিও আমরাও দেখেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরও খবর