মিল মালিক সিন্ডিকেটের কারসাজিতে কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া,টেকনাফ সহ সমগ্র উপকূলে উৎপাদিত লবণের দাম হঠাৎ করে পড়ে গেছে। ভরা মৌসুমে লবণ মিলমালিকেরা সিন্ডিকেট করে প্রতি মণ লবণের দাম ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২৫০ টাকায় নিয়ে এসেছেন। এতে লবণ বিক্রি করে লোকসান হবে বলে আশঙ্কা করছেন জেলার জেলার ৪০ হাজার প্রান্তিক চাষি।
বর্তমানে জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলায় প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। টেকনাফ, কক্সবাজার সদর উপজেলার কিছু এলাকায় প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৮০ টাকায়। তাতে লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ৪০ হাজার প্রান্তিক চাষিসহ প্রায় এক লাখ শ্রমজীবী মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে লবণ মিলমালিকেরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম ২৫০ টাকা হলেও তাঁরা (মিলমালিক) লবণ কিনছেন ৩৬০ টাকা দরে। এ ক্ষেত্রে ১১০ টাকার মুনাফা মধ্যস্বত্বভোগী ও দাদন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাস) টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এসব জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন।
২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩ মাসে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ৬ লাখ ৭৪ হাজার ২৭৭ মেট্রিক টন, যা গত মৌসুমের এ সময়ের তুলনায় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ বেশি উৎপাদন হয়েছে। গত বছর এ সময়ে উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৮ টন। তখন প্রতি মণ লবণ বেচাবিক্রি হয়েছিল ৩৫০ টাকায়।
বিসিক সূত্র জানায়, এখন কক্সবাজার উপকূলে দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে ১০ হাজার মেট্রিক টন লবণ। সাত দিন আগেও প্রতি মণ লবণ বেচাবিক্রি হয়েছিল ৪৮০-৫০০ টাকায়। এ ক্ষেত্রে ১০ হাজার টন লবণের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু কয়েক দিন ধরে লবণের দাম অর্ধেক নেমে আসে। তাতে চাষিরা হতাশ হচ্ছেন। লোকসানের আশঙ্কায় অনেকে লবণ উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তখন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
উপকূলে উৎপাদিত অধিকাংশ লবণ বেচাবিক্রি হচ্ছে কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুরে। সেখানে লবণ প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা (মিল) আছে ৬৯টি। চলতি মৌসমে লবণ কিনছে ৩৫টিতে।
মিল মালিকদের সংগঠন ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ বলেন, চাষিরা মাঠ থেকে এক বস্তা (দুই মণ) লবণ নিয়ে এলে আমরা ৭২০ টাকা পরিশোধ করছি। এ ক্ষেত্রে প্রতি মণ লবণের দাম পড়ছে ৩৬০ টাকা। কিন্তু মাঠপর্যায়ের চাষিরা প্রতি মণ লবণের দাম পাচ্ছেন ২৫০ টাকায়। মধ্যখানে ১১০ টাকা খেয়ে ফেলছেন মধ্যস্বত্বভোগী ও দাদন ব্যবসায়ীরা। চাষিরা নানা শর্তে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রিম দাদন নিয়ে লবণ চাষে নামেন। উৎপাদিত লবণ বিক্রির সময় মণপ্রতি ৪০-৫০ টাকা কমিশন নিয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারিভাবে প্রান্তিক চাষিদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
লোকসানের আশঙ্কায় চাষি
সাগরদ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার লেমশিখালীতে প্রায় দুই হাজার একর জমিতে এখন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে পড়ে আছে সাদা লবণের স্তূপ। বেচাবিক্রি না থাকায় হতাশ চাষি।
লেমশিখালীর চৌমুহনী এলাকায় ৩ একর জমিতে লবণ চাষ করছেন স্থানীয় চাষি মামুনুল ইসলাম। মঙ্গলবার সকালে মাঠে পড়ে ছিল লবণের বড় স্তূপ।
মামুনুল ইসলাম (৪৫) বলেন, সাত দিন আগেও প্রতি মণ লবণ তিনি বিক্রি করেন ৪৯০ টাকায়। এখন সেই লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে ২৫০ টাকায়। আগামীতে লবণের দাম আরও কমতে পারে, এই শঙ্কায় আছেন শত শত চাষি। কারণ, তখন লোকসান দিয়ে চাষিদের লবণ বিক্রি করতে হবে। এখন প্রতি মণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে চাষিদের খরচ হচ্ছে ২১০ টাকার বেশি।
টেকনাফের হ্নীলা, রঙিখালী, জাদিমুরা, সাবরাং, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ এলাকাতেও লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৮০ টাকায়। শাহপরীর দ্বীপের লবণচাষি মোহাম্মদ হোছন (৫৫) বলেন, পাঁচ দিন আগেও তিনি প্রতি মণ লবণ ৪৮০ টাকায় বিক্রি করেন। হঠাৎ প্রতি মণ লবণের দাম ২৫০ টাকা কমে যাওয়ার নেপথ্যে লবণ মিলমালিক সিন্ডিকেটের কারসাজিকে দায়ী করে মোহাম্মদ হোছন বলেন, উপকূলে উৎপাদিত ৯০ শতাংশ লবণ কিনে থাকেন লবণ মিলমালিকেরা। তাঁরা সিন্ডিকেট করে এখন ২৫০ টাকার বেশিতে লবণ কিনতে চাইছেন না।
সাবরাং এলাকার চাষি অজি উল্লাহ (৫৫) বলেন, গত পাঁচ দিনে তিনি এক মণ লবণও বিক্রি করতে পারেননি। কারণ দাম কম। মঙ্গলবার সাবরাং এলাকাতে প্রতি মণ লবণ বেচাবিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৭০ টাকায়।
উৎপাদনের ভর মৌসুমে লবণের মূল্য কমিয়ে দেওয়া হলেও দেখার কেউ নেই জানিয়ে কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল উপকূলের চাষি দিদারুল আলম বলেন, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে তিনি দুই একর জমিতে লবণ চাষ শুরু করেন। ইতিমধ্যে তিনি মাঠে উৎপাদিত ৩০০ মণ লবণ বিক্রি করেন। গত ডিসেম্বর মাসে প্রতি মণ লবণ সর্বোচ্চ তিনি ৫০৫ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। এখন সেই লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে ২৫০ টাকায়।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, পলিথিন প্রযুক্তিতে এখন ৬৬ হাজার একর জমিতে দৈনিক ১০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। তবে মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণ চাষিরা বেচাবিক্রি করছেন ২৫০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে, যা সাত দিন আগেও বিক্রি হয়েছিল ৪৮০-৫০০ টাকায়।
কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, ডিসেম্বরে লবণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে নতুন করে লবণ উৎপাদনে নামেন। এখন দাম কমে যাওয়ায় অনেকে হতাশ হয়ে লবণের উৎপাদন বন্ধ রাখার চিন্তাভাবনা করছেন। লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে লবণ উৎপাদনের সক্ষমতা অনেকের নেই।
সূত্র : আব্দুল কুদ্দুস রানা,দৈনিক প্রথম আলো।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-