উদিসা ইসলাম, বাংলা ট্রিবিউন •
মানবপাচার থেকে সোনা কেনাবেচা কিংবা হোক তা বিদেশের অবৈধ টাকা, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাজারে সেসব অর্থ ‘বৈধ’ করতে ইয়াবা একটি অন্যতম ‘বিনিময় পণ্য’ হয়ে উঠেছে।
ব্যাংক অ্যাকাউন্টহীন এসব ক্যাম্পের মানুষদের কাছে বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স সামাল দিতেও কাজে লাগে ইয়াবা। টেকনাফ ও উখিয়াজুড়ে ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে ইয়াবা যেন একটি নতুন কারেন্সি। যেকোনও অপরাধের লেনদেনের ক্ষেত্রে একলাখ টাকা ক্যাশ না দিয়ে আপনি ইয়াবা দিতে পারেন। এক লাখ টাকার ইয়াবা পরে দেশের বাজারে পাঁচ গুণ বেশি দামে বিক্রি হবে।
উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি দিনই ক্যাম্পগুলোর ভেতরে বসে মাদকের হাট। বিকাল ৪টায় সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা ক্যাম্প ত্যাগের পর— সেটা একটা ভিন্ন জগৎ। ৪টা পর্যন্ত যারা লুকিয়ে থাকে, সন্ধ্যার পরে তারা বেরিয়ে আসে। সেটা হতে পারে বিভিন্ন উগ্রগোষ্ঠীর সদস্য, বিদেশ পাঠানোর দালাল, অপহরণের হোতারা। আর সন্ধ্যার পরের সেই হাটে সব লেনদেন হয় ইয়াবা দিয়ে। তারা এও জানান, উখিয়ার কিছু আদি বাসিন্দাদের অনেকে ক্যাম্পের মাদকের হাটে আসে।
কিভাবে সম্ভব হয় কেবল ইয়াবা দিয়ে লেনদেন প্রশ্নে ২২ বছর বয়সী এক যুবক বলেন, ক্যাম্প থেকে দল বেঁধে মাছ শিকারে যাওয়া হয়। ফেরার পথে যেকোনও উপায়ে লুকিয়ে ইয়াবা আনা হয়। এবং রাত করে ক্যাম্পেই মজুত করা হয়। এই পুরো কাজ করার সময় আমরা ঘাটে ঘাটে টাকা দেই। এই যে বললাম— ঘাটে ঘাটে টাকা দিই, সেটা সবসময় যে টাকাই দিই তা না, ইয়াবাও দিই। এখানে সবাই জীবনে একবার হলেও বড় ইয়াবা চালানে যুক্ত হবে, সেই পরিকল্পনা করতে থাকে। তিনি আরও বলেন, ধরেন ৫০ টাকার ইয়াবা ঢাকা পৌঁছায়ে ৫০০ টাকা হয়ে যায় কিভাবে? সেই হিসাব পেলেও বুঝবেন। ওই টাকা মানে ইয়াবা দিয়েই। তারপরেও যদি ধরা পড়ি, তাইলে বুঝতে হবে ওইসব বনিবনার ঝামেলা।
এটা গেলো ইয়াবা এদেশে নিয়ে আসার কথা। যে লোক বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। সে কী করে ইয়াবা কাজে লাগায়? দালালকে যদি তার এক লাখ টাকা দিতে হয়, তবে সে সমপরিমাণ ইয়াবা দিয়ে কাজ চালায়। কুতুপালং ক্যাম্পে এরকম একাধিক ঘটনার খোঁজ মেলে। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে রওনা দেওয়ার সময় যে শর্ত থাকে তা হলো— ওখানে গিয়ে কল করে পৌঁছানোর খবর দিলে, এখানে ইয়াবা বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি স্বর্ণালঙ্কার কেনার ক্ষেত্রেও ইয়াবা কারেন্সি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইতোমধ্যে একাধিক অপহরণ ঘটনায় পরবর্তী সময়ে ইয়াবা দিয়ে ছাড়িয়ে আনার মতো সমাধানেরও খোঁজ মেলে ক্যাম্পে।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে পুরো প্রক্রিয়াটা এই প্রতিবেদককে বুঝিয়ে দেন এক ইয়াবা ব্যবসায়ী। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ধরেন আমি আমার সোর্সে ইয়াবা আনি। ক্যাম্পে রাখি। তারপর কক্সবাজারের ব্যবসায়ীর কাছে দেই দ্বিগুণ দামে। কিন্তু সেই টাকা থেকে আমি মিয়ানমারের সোর্সকে টাকা পরিশোধ করি, তাদের ওখানকার যে মূল্য সেই পরিমাণ এবং টাকাটা হুন্ডি করি। এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যারা যুক্ত তাদেরকে আমার কিছু পরিমাণ ইয়াবা দিতে হয়। বিনা পয়সায়।
ইয়াবার এই বিশাল বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে রোহিঙ্গা- বাঙালি মিলে। যেকোনও লেনদেনে অর্থের বদলে ইয়াবাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কারা এই বাজারের নিয়ন্ত্রণে আছে, সে বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কিনা, জানতে চাইলে র্যাব- ১৫ এর একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের ছত্রছায়ায় প্রত্যক্ষ মদতে বাংলাদেশে ঢুকছে ইয়াবার চালান। কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা ইয়াবা পাচারে সক্রিয় রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া অনেকের অবস্থান মিয়ানমারে হওয়ায় তাদেরকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। মাদকের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে যাচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মিজানুর রহমান বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, এখানে ইয়াবা বড় মিডিয়াম। এত হাজার ইয়াবা দিয়ে পাচার করা হলো। এখানে অপহরণের কেস হয় মাঝে মধ্যে সেটার মূল ইয়াবা। কখনও কখনও জিম্মি করে পাহাড়ে রাখা হয়। শর্ত হচ্ছে, ইয়াবা পাচার হবে এপারে। তারপরে ক্যাশ হবে, তারপরে অপহৃতকে ছেড়ে দেবে। এটা বিকাশ বা ইয়াবার মাধ্যমে হতে পারে। ইয়াবা এখানে কারেন্সি। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে লেনদেন এখানে হয়, সেখানে লক্ষাধিক টাকা কোনও প্রশ্ন ছাড়া চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।’
এটা নিয়ে আপনাদের কোনও মনিটটরিং আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি কোনও কমিটিতে আলোচনা হতে দেখিনি। এসব অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে মানি এক্সচেঞ্জাররাও জড়িত, হুন্ডি জড়িত।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-