একেকটিতে খরচ ৪০-৫০ হাজার টাকা দালাল চক্র সক্রিয় পুলিশ ভেরিফিকেশনে কঠোর হওয়ার নির্দেশনা

রোহিঙ্গারা কীভাবে পায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট

বিশেষ প্রতিবেদক •

বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। নব্বই দশক থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হলেও ২০০০ সালের পর তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে দালালদের সহযোগিতায় সহজে পাসপোর্ট পেয়ে যায় রোহিঙ্গারা।

বর্তমানে সৌদি আরব, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আড়াই লাখ থেকে পাঁচ লাখ বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে বলে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রতিরোধ কমিটির প্রতিবেদনে জানা যায়।

সর্বশেষ গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার পথে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশ আসাদুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গাকে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। তার কাছ থেকে ‘এ০–৫৫৭০৯৪৯’ নম্বরের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।

উখিয়া থানার একটি হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে তাকে আটক করার পর জানা যায় তিনি মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অ্যালায়েন্স আরসার নেতা।

মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গা আসাদুল্লাহ কীভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছে, তা তদন্ত করা হবে বলে জানান নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিবি উত্তর) নিহাদ আদনান তাইয়ান।

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, আগে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিভাগ থেকেই রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট তৈরি করত। বর্তমানে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় জন্মনিবন্ধনের পাশাপাশি পুলিশ ভেরিফিকেশনে কঠোর হওয়ার জন্য প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করার বিষয়টি সম্পর্কে উখিয়া থানার সাবেক ওসি ও বর্তমানে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক মর্জিনা আকতার আজাদীকে বলেন, ধরেন, ময়মনসিংহে এক নারীর নাম মরিয়ম। তিনি বাংলাদেশেরই নাগরিক। তার একটি ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে। ওই ন্যাশনাল আইডি কার্ডটি জোগাড় করা হয়। নাম ঠিকানা, পিতা বা স্বামীর নাম সবই ঠিক থাকে। ছবিও তার। এই একটি ডকুমেন্ট ধরেই আরো প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট পাওয়া যায়। এরপর ওই নামেই আরেক রোহিঙ্গা নারীর জন্য পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা হয়। কেউ ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে গিয়ে ধরা পড়েন, কেউবা অন্য কোনো পর্যায়ে। আর যারা ধরা পড়েন না তারা পাসপোর্ট পেয়ে যান।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেন কারা? এ বিষয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের অনেক আত্মীয়স্বজন মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের আরো অনেক দেশে থাকেন। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকদের পরিচয় হয়। তাদেরই কেউ কেউ দেশে লোক ধরে এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন। এর বাইরে একটি দালালচক্রও গড়ে উঠেছে। ভাষার কারণে অনেক রোহিঙ্গা ধরা পড়ে। যারা ভাষা রপ্ত করতে পারেন তাদের ধরা কঠিন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এর সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের এক শ্রেণির কর্মচারীর যোগসাজশ আছে। কারণ, তা না থাকলে ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই ধরা পড়ে যাওয়ার কথা। তাছাড়া পুলিশও সহায়তা করে, কারণ পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট ছাড়া পাসপোর্ট হয় না।

জানা গেছে, দালালরা প্রথমে তাদের মক্কেলের সমবয়সী স্থানীয় বাংলাদেশির আসল জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে। এরপর ওই পরিচয়পত্র দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে আসল পরিচয়পত্র, প্রকৃত ব্যক্তির ছবি ও জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে। রোহিঙ্গার আসল পরিচয় তখন গোপন করা হয়। এরপর তারা পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করে ও পাসপোর্টের জন্য ছবি তোলে। অসাধু কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে তাদের সাহায্য করেন। রোহিঙ্গাদের একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট করে দেয়ার জন্য ৪০–৫০ হাজার টাকা দাবি করে দালালরা।

মোশাররফ মিয়া ও সেলিম নামে দুই ব্যক্তির রোহিঙ্গা থেকে বাংলাদেশি হওয়ার কাহিনি জানালেন সিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়া মোশাররফ মিয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ২০০১ সালে বাংলাদেশে আসেন ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। কয়েক মাসের মধ্যে তিনি স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ পান। এর পরের এক দশক ধরে স্থানীয় বাসিন্দা ও বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ২০১২ সালের শেষ দিকে নিজের জন্য বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র জোগাড় করতে সক্ষম হন তিনি। তারপর বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে সৌদি আরব চলে যান। মোশাররফের স্ত্রী খাদিজাও ২০০২ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। খাদিজা ও তার দুই ছেলেরও বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। তার দুই ছেলে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে আর তারা স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করছে।

মিয়ানমারের বুথিয়াডং কিনিসি এলাকা থেকে পালিয়ে আসা আরেক রোহিঙ্গা সেলিম। তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে মালয়েশিয়া ঘুরে এসেছেন। কিন্তু ভুয়া কাগজপত্রের কারণে মালয়েশিয়া সরকার তাকে ফেরত পাঠিয়েছে। এখন তিনি আরেকটি মুসলিম দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, কতিপয় দালাল চক্রের সহায়তায় টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, টাকা খরচ করলেই রোহিঙ্গারা এনআইডি পেয়ে যাচ্ছে। পরে এনআইডি ব্যবহার করে পাসপোর্টে আবেদন করছেন তারা। তবে এ ধরনের অবৈধ কাজের বিরুদ্ধে পুলিশ সতর্ক আছে।

আরও খবর