টেকনাফ অফিস •
দেশের দক্ষিণের স্থল ভাগের সর্বশেষ ঠিকানা শাহপরীর দ্বীপ। যার অধিকাংশ এলাকা বাঁধ ভেঙে জোয়ার–ভাটায় তলিয়ে যেত। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ত এ দ্বীপে বসবাসকারী অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে অনেক সম্পদও।
এক দশক পর এসব থেকে মুক্তি মিলছে এ দ্বীপবাসীর। দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিললেও শাহপরীর দ্বীপের সংস্কার করা সড়কে লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানিতে পিচ্ছিল হচ্ছে নতুন মহাসড়ক। ফলে বিপজ্জনক এ মহাসড়কে প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা। পড়ছে নতুন আরেক দুর্ভোগে। নিয়ম থাকলেও লবণবাহী ট্রাকে জিইওট্যাক্স (মোটা ত্রিপল) ব্যবহার করা হচ্ছে না।
জানা যায়, এ মৌসুমে শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় লবণ উৎপাদিত হয় বেশি। নৌপথ ও স্থলপথে এসব লবণ দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করা হয়। নৌপথে পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় মূলত সড়কপথে ট্রাকে করেই এসব স্থানে লবণ পরিবহন করা হয়।
নিয়মানুযায়ী লবণবাহী ট্রাকে জিইওট্যাক্স ব্যবহার না করায় পুরো রাস্তায় ঝরে ঝরে পানি পড়ে। এছাড়া মহাসড়ক হয়ে বিভিন্ন স্থানে পরিবহনের সময় কাঁচা মাটি পড়ে। রাতে কুয়াশার স্পর্শে লবণ নিঃসৃত পানি ও কাঁচা মাটি রাস্তায় আঠালো আস্তরণ সৃষ্টি করে।
ফলে চলমান গাড়ি ব্রেক কষলেই আঠালো আস্তরণের স্পর্শে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ঘটে দুর্ঘটনা। প্রতিদিনের মহাসড়কের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। হচ্ছে প্রাণহানি। আবার অনেকে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছে।
শাহপরীর দ্বীপ দীর্ঘ ১০ বছর পর নতুন সড়ক পেয়েছে। চাকুরিজীবীসহ অনেকে সকালে শহরে এসে রাতে ঘরে ফিরেন। অনেকে সন্ধ্যা হলে মোটর সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। নতুন সড়ক উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে শাহপরীর দ্বীপ মানুষের আসা যাওয়ায় আরেক বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে লবণ নিঃসৃত পানি।
গত চারদিন আগে সিএনজি খালে নেমে গেছে বলে জানান চালক মোহাম্মদ হোসেন। শাহপরীর দ্বীপ রাস্তার বড় ব্রিজের আগে ছোট–বড় প্রায় ৩০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি। আহত হয়েছে অনেকে।
এর মধ্যে টেকনাফ পৌর সভার ৮ নং ওয়ার্ড জালিয়াপাড়ার দুই সহোদর মহিউদ্দিন ও আফাজউদ্দীন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। টেকনাফ থেকে রাতে শাহপরীর দ্বীপ যাওয়া যাত্রীরা আতংকে আর ঘরে ফিরেন না।
কেউ কেউ বিকল্প পথ ব্যবহার করেন বলে জানিয়েছেন। শাহপরীর দ্বীপ ৮নং ওয়ার্ড ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি মুহাম্মদ জুবায়ের জানান, এক সপ্তাহ আগে টেকনাফ হয়ে মোটর সাইকেল যোগে শাহপরীর দ্বীপ ফেরার পথে লবণ নিঃসৃত পানিতে পিচ্ছিল রাস্তায় ব্রেক কষলেই আঠালো আস্তরণের স্পর্শে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। প্রায় ১০ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম।
স্থানীয় সাংবাদিক জাকারিয়া আলফাজ জানান, প্রায় এক দশক পর শাহপরীর দ্বীপে ভেঙে যাওয়া সড়ক নতুন ভাবে ফিরে পাওয়ায় এ সড়কে দিন দিন গাড়ি চলাচল বাড়ছে। কিন্তু সড়ক সুন্দর হলেও দুর্ঘটনা হচ্ছে। অন্যদিকে গাড়ি চালকদের কে কার আগে যাবে এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা তো রয়েছেই।
ফলে পিচ্ছিল সড়কে ওভারটেক করতে গিয়ে দুই গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে। নতুবা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যাচ্ছে। দুর্ঘটনা রোধে চালকদের পাশাপাশি সড়কে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। প্রশাসনের পক্ষ থেকে লবণ পরিবহনে ট্রাকে পলিথিন ব্যবহারে বারবার অবহিত করা হলেও লবণ ব্যবসায়ীরা সেটিতে কর্ণপাত করছেন না।
মোটর সাইকেল আরোহী নুরুল আমিন জানান, প্রতিদিন লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানিতে মহাসড়ক পিচ্ছিল হয়ে যায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত হারিয়াখালী থেকে শাহপরীর দ্বীপ সড়কে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
আবার দিনে সূর্যের আলোতে পিচ্ছিল রাস্তা শুকিয়ে গেলেও অনেক জায়গায় গাছপালার কারণে আলো না পড়ায় পিচ্ছিলই থেকে যায়। তাই মহাসড়কে মোটর সাইকেল চালানোর সময় সামান্য ব্রেক কষলেই দুর্ঘটনা ঘটে। আবার অনেক সময় রাস্তা এতো পিচ্ছিল থাকে ব্রেক না কষলেও দুর্ঘটনা ঘটে। আঠালো মহাসড়কে গাড়ি চালাতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলে একাধিক চালক জানিয়েছেন।
শাহপরীর দ্বীপ ৮ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রেজাউল করিম বলেন, লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানি ও পরিবহনের সময় কাঁচা মাটি রাস্তায় পড়ে একটি আস্তরণ সৃষ্টি হচ্ছে। ওই আস্তরণে কুয়াশার স্পর্শে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যায়। ফলে সড়কে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।
এদিকে, এই মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকবাহী গাড়ি টেকনাফ যায় এবং আসে। আগে থেকে এই সড়ক সম্পর্কে চালকদের ধারণা না থাকায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে। তাই লবণবাহী ট্রাক থেকে যাতে পানি নিঃসৃত না হয় ও পরিবহনের সময় কাঁচা মাটি রাস্তায় না পড়ে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর হস্তক্ষেপ জরুরি।
জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা লবণ চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিক মিয়া জানান, নিয়মানুযায়ী লবণবাহী ট্রাকে জিইওট্যাক্স ব্যবহার করতে হবে না করলে পুরো রাস্তায় পানি ঝরে পড়ে। এ বিষয়ে লবণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নিব।
টেকনাফ ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ মোশারফ হোসেন জানান, টেকনাফে যেকোনো সড়কে লবণবাহী ট্রাকে উপরে–নিচে মোটা ত্রিপল ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাতে লবণ নিঃসৃত পানি মহাসড়কে না পড়ে। কেউ নির্দেশ অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে অভিযান চালানো হবে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অতিশীঘ্রই লবণ মালিকদের সঙ্গে বসব। যাঁরা সড়কের পাশে লবণ আনলোড করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-