মানব পাচার চক্রের ৫০০ সদস্য চিহ্নিত: মহেশখালী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সক্রিয় তারা!

জামিউল আহসান সিপু •

মালায়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য ট্রলারে সাগর পাড়ি দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে তারা বেছে নিয়েছেন গভীর রাত। মাঝেমধ্যেই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তাদের এই যাত্রায় ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে ভাসতে দেখা যাচ্ছে মাঝ সাগরে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের উদ্ধার করেছেন কোস্ট গার্ডের সদস্যরা। রোহিঙ্গাদের এমন যাত্রাকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরুত্সাহিত করা হলেও দালাল চক্রের কারণে তা সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানা গেছে। এই চক্রের সদস্যরা এক সময় ইয়াবাকারবারী হিসেবে পরিচিত ছিল। তারাই এখন স্থানীয় চক্রের সহায়তায় ট্রলার কিনে সাগর পথে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে মানব পাচার করছে।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কক্সবাজারে এক সরকারি সফরকালে মানব পাচারের দালাল চক্র ও মাদককারবারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানান। একই সঙ্গে বিভিন্ন এজেন্সির দেওয়া তালিকা সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।

গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলায় বর্তমানে ১৩ থেকে ১৫টি দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রত্যেক চক্রে ১৫ থেকে ২৫ জন সদস্য রয়েছে। এই চক্রের সদস্যরা প্রথমে যারা মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর যেতে চায়—তাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ২০ হাজার করে টাকা নেয়। ঐ টাকার বড় অংশ স্থানীয় চক্রকে দেয়। কিছু টাকা দিয়ে ট্রলার কিনে। এরপর সবকিছু ঠিক করে মাথাপিছু আরো ৩০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা নেয়। এরপর ট্রলারে কিছু শুকনা খাবার তুলে দিয়ে পাড়ি দেয় সাগর পথে।

সূত্রমতে, সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ মানব পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হলেও পাচারকারী চক্রের বিস্তৃতি রয়েছে মহেশখালী পর্যন্ত। মহেশখালীতে পাচারকারী চক্রের প্রধান ‘ঘাঁটি’ হচ্ছে কুতুবজোম ইউনিয়ন। উখিয়ার সোনারপাড়াসহ আশেপাশের এলাকায় ২০ জনের বেশি এবং টেকনাফে রয়েছে অর্ধশত পাচারকারী। এসব পাচারকারীদের সমন্বয়ে পৃথকভাবে রয়েছে ১০টির বেশি চক্র।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল দিয়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর কাজে জড়িত অন্তত ৫শ দালালকে তারা চিহ্নিত করেছে। মূলত রোহিঙ্গাদের ঘিরেই এই চক্রটি বেশি সক্রিয়। রোহিঙ্গাদের মাদক বিক্রির টাকাই মূলত দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছেন বলে স্থানিয়রা দাবি করেছেন।

গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা অনুযায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর মানব পাচারের দালাল হিসেবে কাজ করছে ১৬ নম্বর ক্যাম্পের মো. সায়ীদের ছেলে রোহিঙ্গা মো. রফিক ও বাদশা মিয়ার ছেলে হারুনের নেতৃত্ব অন্তত ৫০ জন। এই চক্রের সদস্যরা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও বাহারছড়া উপকূল দিয়ে বেশির ভাগ মানুষ মালয়েশিয়ায় পাচার করছে। এখানে দালালচক্রের নেতৃত্বে আছে শাহপরীর দ্বীপের ধলু হোসেন ও শরীফ হোসেন। তাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় অন্তত ১২টি মামলা রয়েছে। টেকনাফের সাবরাং এলাকার আকতার কামাল, সাঈদ কামাল, মোয়াজ্জেম হোসেন, রামুর কালিমারছড়ার মোহাম্মদ হোসেন, শাহপরীর দ্বীপ মাঝরপাড়ার জায়েত উল্লাহ, সব্বির আহাম্মদ, সাজেদা বেগম, আব্দুল্লাহ, ইউনুচ, কলিম উল্লাহ, আব্দুস শুক্কুর, ঘোলাপাড়ার শামসুল আলম, কবির আহমদ, হাজীপাড়ার মুজিব উল্লাহসহ অন্তত ২৫০ জনের নাম এসেছে।

টেকনাফের বাইরে দালাল হিসেবে পুলিশ চিহ্নিত করেছে প্রায় ২০০ জনকে। এই তালিকায় নরসিংদীর শাহজালাল, নুর মোহাম্মদ ওরফে ইমরান, জিয়াউর রহমান, আবদুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের রফিকুল ইসলাম, শহিদ উল্লাহ, আবদুস সাত্তার, চুয়াডাঙ্গার আকিম, কাশেম, আকিল উদ্দিন, সিরাজগঞ্জের সাত্তার মোল্লা, কুড়িগ্রামের সালাম, সাতক্ষীরার আশরাফ মিয়া, বগুড়ার সাহাব উদ্দিন, যশোরের আবুল কালাম, মেহেরপুরের আহাম্মদ উল্লাসহ অন্তত ২০০ জনের নাম রয়েছে।

মানব পাচারের তালিকায় থাকা কয়েকটি বড় চক্র রয়েছে মহেশখালীর কুতুবজোনে। এর মধ্যে বড় চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে তাজিয়াকাটা এলাকার করিম উল্লাহর ছেলে নূর ওরফে বার্মাইয়া নূর। এই চক্রের সক্রিয় নেতৃত্বে রয়েছে, নূরের ভাই সেলিম, তাদের দূর সর্ম্পকীয় ভাগিনা সোহেল, কুতুবজোম পশ্চিম পাড়ার বাদশা মেম্বারের পুত্র আবদুর রহিম ও তার ফুফাতো ভাই লুতু মিয়া।

এই চক্রটি এই মৌসুমে ব্যাপক সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নূর চক্রের অন্যতম প্রধান হোতা টেকনাফের সাবরাংয়ের কাটাবনিয়ার হাসান আলীর পুত্র শহিদ উল্লাহ, যাকে বিভিন্ন মানব পাচার মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে। তার কাজ জাহাজের সাথে লেনদেন করা। জাহাজ ম্যানেজ করে চূড়ান্তভাবে যাত্রীদের মালয়েশিয়া পাঠানো হয় বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে খালি কনটেইনারে তাদের স্থান হয়। নাওয়া খাওয়া বন্ধ অবস্থায় তাদের কাটাতে হয় মাসের পর মাস। মাঝেমধ্যে শুকনো কিছু খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে ফেলে দেওয়া হয় মাঝ সাগরে।

উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে এনে কুতুবজোনসহ বিভিন্ন গোপন আস্তানায় একত্রিত করে পাচারকারী চক্র। তাজিয়াকাটা ঘাট থেকে রাতেই যাত্রা করে বঙ্গোপসাগরের উখিয়ার সোনারপাড়া, টেকনাফের বাহারছড়া শীলখালী ও নোয়াখালী পাড়াসহ এইসব স্থান থেকে ট্রলারে উঠানো হয়। এরপর গভীর সাগরে অপেক্ষমান মালয়েশিয়াগামী জাহাজের উদ্দেশ্য যাত্রা করে ট্রলারগুলো। প্রতিটি ট্রলারে পাচারকারী চক্রের অন্তত ১০ জন থাকে। যাদের কাজ হুমকি দিয়ে ও মারধর করে মালয়েশিয়াগামীদের কাছ থেকে টাকা আদায় ও জিম্মি করে রাখা। অনেক সময় বোট ডুবে গেলে তারা সাঁতরে মাছধরার ডিঙি নৌকায় আশ্রয় নেয়।

এ ব্যাপারে কুতুবজোনের ইউপি চেয়ারম্যান শেখ কামাল বলেন, কুতুবজোনকেন্দ্রিক মানব পাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে এটা ঠিক। মূলত চিহ্নিত ইয়াবা পাচারকারী চক্রগুলোই মানব পাচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কম ঝামেলায় বেশি টাকা আয়ের লোভেই ইয়াবা ব্যবসীয়রা শুষ্ক মৌসুমকে কেন্দ্র করে মানব পাচারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই বিষয়টি আমি বিভিন্ন সময় প্রশাসনকে জানিয়েছি। ইয়াবা ও মানবপাচার রোধে আমার যা সহযোগিতা করা দরকার, প্রশাসন চাইলে আমি তা করব।

আরও খবর