আবদুল কুদ্দুস রানা, কক্সবাজার •
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্ট কয়েক দিন ধরে লাখো পর্যটকে ভরপুর। সকালে সমুদ্রের লোনাজলে নেমে শরীর ভেজান হাজারো নারী-পুরুষ। দ্রুতগতির নৌযান ‘জেটস্কি’ নিয়ে ঘুরে আসেন সমুদ্রের বিশাল জলরাশি। কেউ ঘোড়ার পিঠে বা বিচ বাইকে চড়ে ঘুরে বেড়ান সৈকতের এদিক-সেদিক।
বিকেলে বালুচরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত উপভোগ করার পর লাখো পর্যটকের সময় কাটানোর তেমন কাজ থাকে না। সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দল বেঁধে পর্যটকেরা ভিড় করেন সুগন্ধা সড়ক, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সড়ক, কলাতলী সৈকতসহ বিভিন্ন পয়েন্টে।
উদ্দেশ্য, তেলে ভাজা রকমারি সামুদ্রিক মাছ খাওয়া। তবে ভাজা মাছ বিক্রির ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোর বিরুদ্ধে পাওয়া যাচ্ছে বিস্তর অভিযোগ।
ওই স্থানগুলোতে ভাজা মাছ বিক্রির ভ্রাম্যমাণ দোকান বা ‘ভ্যান রেস্তোরাঁ’ আছে প্রায় ২১০টি। কোনোটির লাইসেন্স নেই। প্রতি রাতে এসব দোকানে লাখ লাখ টাকার ভাজা মাছ বেচাবিক্রি হচ্ছে। কিন্তু প্রায়ই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পাম তেল ও পোড়া সয়াবিন তেলে ভাজা এসব মাছ খেয়ে পর্যটকদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ভাজা মাছগুলো পচা-নষ্ট কি না, এসব যাচাই–বাছাই করতে কাউকে দেখা যায় না। এসব ভাজা মাছ পর্যটকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ালেও লাইসেন্সবিহীন ভ্যান রেস্তোরাঁগুলো উচ্ছেদে প্রশাসন তেমন তৎপর নয়। কোনো দোকানে ভাজা মাছের দামের তালিকাও টাঙানো নেই। ইচ্ছেমতো আদায় হচ্ছে টাকা।
ভ্যান রেস্তোরাঁর মালিকেরা বলছেন, প্রতি রাতে একেকটি ভ্যান রেস্তোরাঁয় বেচাবিক্রি হয় ১৫ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকার মাছ। তাতে অর্ধেক টাকা লাভ হয়। তবে স্থানীয় মাস্তান, বিচকর্মী, পুলিশসহ বিভিন্ন খাতে প্রতি রাতে ৪ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।
ভাজা মাছ খেয়ে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন পর্যটক অসুস্থ হচ্ছেন জানিয়ে ক্যাব কক্সবাজার জেলার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, দিনের বেলায় ভ্যান রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ রাখা হয়। কারণ, দিনের আলোয় মানুষ পচা মাছ দেখলে বুঝতে পারেন। ভ্যান রেস্তোরাঁ চালু হয় সন্ধ্যার পর রঙিন বাতির আলোয়। হলুদ, ময়দা-মসলামিশ্রিত ভাজা মাছ রঙিন আলোয় উজ্জ্বল দেখায় এবং পর্যটকেরা খেতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
গত মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে দেখা যায়, সুগন্ধা সড়কের উত্তর পাশে পরিত্যক্ত একটি পুকুরের পাড়ে এবং সড়কের পাশে ভাজা মাছ বিক্রির ভ্যান রেস্তোরাঁ বসেছে প্রায় ৫০টি। ভ্যানগাড়িতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রকমারি সামুদ্রিক মাছ। কিছু কাঁচা, কিছু ভাজা।
পর্যটকেরা দল বেঁধে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, কেউ কেউ ফুটপাতে বসে ভাজা মাছ খাচ্ছেন। দোকানের এক পাশে কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে মাছ। গরম-গরম ভাজা মাছ ভ্যানে রাখার পরপরই পর্যটকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন, কে আগে নেবেন।
বেশির ভাগ পর্যটকের হাতে ছিল ভাজা কাঁকড়া, চিংড়ি ও লইট্টা ফ্রাই। কেউ খাচ্ছেন অক্টোপাস, মাইট্যা, কোরাল, রাঙাচকি, টুনা মাছ ইত্যাদি। কোনো দোকানে ভাজা মাছের দামের তালিকা টাঙানো নেই।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পাশের সড়কে ভ্যান রেস্তোরাঁয় ভাজা মাছ বিক্রি করছিলেন গফুর আলম নামের এক ব্যক্তি। ২০-২৫ জন পর্যটক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মাছের দরদাম করছিলেন। সিলেটের ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম (৫০) তাঁর স্কুলপড়ুয়া ছেলের আবদার মেটাতে অক্টোপাস দিতে বলেন। গফুর প্লাস্টিকের বোতলের ভেতর থেকে একটি মরা অক্টোপাস বের করে দুই হাতে তুলে ধরে দাম হাঁকলেন ৬০০ টাকা। সাড়ে ৫০০ টাকায় দরদাম ঠিক হওয়ার পর অক্টোপাসটি রান্নার জন্য প্রথমে হলুদ, তারপর ময়দা মিশিয়ে কড়াইয়ের উত্তপ্ত তেলে ছেড়ে দেওয়া হলো। মুহূর্তে ভাজা অক্টোপাস প্লেটে ভরে তুলে দেওয়া হলো ক্রেতার সামনে।
জহিরুল ইসলাম বলেন, জীবনে প্রথমবার স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছেন। হাজার হাজার মানুষ ভাজা মাছ খাচ্ছেন দেখে তাঁরাও খেতে এসেছেন। কিন্তু মাছে যে ভেজাল আছে, সে কথা জানা ছিল না।
পর্যটকদের ঠকিয়ে পচা মাছ বিক্রির কারণ জানতে চাইলে গফুর আলম প্রথমে ধমকের সুরে কথা বলেন। পরিচয় জানার পর বলেন, পর্যটকেরা সামুদ্রিক মাছ তেমন চেনেন না। পচা না নষ্ট, তা–ও বোঝেন না। ব্যবসায়ীরা ফরমালিন, কেমিক্যাল, রং, হলুদ ও মসলা মিশিয়ে পচা সামুদ্রিক মাছ পর্যটকদের খাওয়ালেও তিনি এসব করেন না।
সুগন্ধা সড়কে একটি ভ্যান রেস্তোরাঁয় ভাজা মাছ বিক্রি করছিলেন আবুল মনজুর নামের এক যুবক। দোকানে প্রতিটি লইট্যা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়, মাইট্যা ৩০০-৮০০, লাল চিংড়ি (রেড টাইগার) ৫০-৭০, কাঁকড়া ১২০-৩৫০, টুনা মাছ ৩০০-৬০০, রাঙাচকি ৬০০-১২০০, লুয়ামারি ২০০-৩০০, কোরাল ৮০০-১৫০০, টেকচান্দা ৩০০-৫০০, লবস্টার ১২০০-২৫০০ টাকায়।
আবুল মনজুর বলেন, এখন লাখো পর্যটকে ভরপুর সৈকত। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এই দোকানে বিক্রি করেছেন ৪৭ হাজার টাকার ভাজা মাছ। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভাজা মাছ বেচাবিক্রির মহোৎসব চলবে।
ভ্যান রেস্তোরাঁর পেছনে ময়লা পানিযুক্ত একটি পরিত্যক্ত পুকুর। দোকানের আশপাশে এবং মাছের ওপর মশা-মাছির উৎপাত। চুলার ওপর বসানো কড়াইয়ের পাশে প্লাস্টিকের বোতলে ভর্তি পোড়া সয়াবিন তেল। এসব তেলে ভাজা হচ্ছে মাছ। পোড়া তেল খোলাবাজার থেকে কেনা বলে জানান দোকানি আবুল মনজুর।
একই অবস্থা আশপাশে আরও ৪০-৫০টি দোকানের। কোনো দোকানের সাইনবোর্ড না থাকায় পর্যটকেরা অসুস্থ বা হয়রানির শিকার হলে দোকান চিহ্নিত করে অভিযোগ করতে পারেন না। অভিযোগ করলেও চার চাকার ভ্যান রেস্তোরাঁ মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, এখন সাগরে তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। কয়েক মাস আগে কেনা লইট্যা, রেড টাইগার চিংড়ি, লবস্টার, অক্টোপাস, মাইট্যা ভেজে চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। খাওয়ার অনুপযুক্ত পচা মাছে ভিনেগার দিয়ে সতেজ করা হয়। পচা গন্ধ দূর করতে মেশানো হয় হলুদসহ অতিরিক্ত মসলা। এরপর মাছের ওপর ময়দার প্রলেপ দিয়ে আগুনে ভাজলে এর আসল-নকল পরখ করা কঠিন হয়ে যায় পর্যটকদের জন্য।
সিগাল ও কলাতলী পয়েন্টে ভাজা মাছ বিক্রির ভ্যান রেস্তোরাঁ আছে প্রায় ৮০টি। সুগন্ধা সড়কের আধা কিলোমিটারে ৭২টি, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ১১টি, সিগাল-লাবণী সড়কে ৪৫টিসহ মোট ২১০টি ভ্যান রেস্তোরাঁয় এক রাতে বেচাবিক্রি হচ্ছে অন্তত ২১ লাখ টাকার (প্রতি দোকানে গড়ে ১০ হাজার টাকা) ভাজা মাছ। এক মাসে বেচাবিক্রি হচ্ছে ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার মাছ। অথচ এর বিপরীতে সরকার এক টাকাও রাজস্ব পাচ্ছে না।
জেলা প্রশাসনের পর্যটন শাখার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, ভ্যান রেস্তোরাঁগুলোর কোনোটির লাইসেন্স নেই। ভাজা মাছ খেয়ে পর্যটকেরা অসুস্থও হচ্ছেন দেখে প্রায় সময় অভিযান চালিয়ে এসব দোকান উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু একদিক দিয়ে উচ্ছেদ করলে অন্যদিক থেকে পুনরায় বসে যায় ভ্যান রেস্তোরাঁ। চার চাকার ওপর বলে মুহূর্তে দোকানগুলো সরিয়ে ফেলা যায়।
কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বলেন, শহরে রেস্তোরাঁ আছে ছয় শতাধিক। এর মধ্যে সমিতির আওতাধীন ১২০টি রেস্তোরাঁর সব কটিতে লাইসেন্স আছে। তারকা মানের আরও ৩০টি রেস্তোরাঁর লাইসেন্স রয়েছে। লাইসেন্সধারী রেস্তোরাঁয় খাবারের মূল্যতালিকা টাঙানো থাকে।
অবশিষ্ট ৪৫০টির বেশি রেস্তোরাঁর লাইসেন্স নেই। এর মধ্যে ভয়ংকর অবস্থা ভাজা মাছ বিক্রির দুই শতাধিক ভ্যান রেস্তোরাঁ। পাম তেল ও পোড়া সয়াবিন তেলে ভাজা পচা-নষ্ট মাছ খাওয়া হচ্ছে পর্যটকদের। তাতে প্রতিদিন ১০-১২ জন নারী-পুরুষ অসুস্থ হচ্ছেন।
কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, পোড়া তেলে ভাজা মাছ ও নিম্নমানের খাবার খেয়ে শত শত পর্যটক অসুস্থ হলে এবং ইচ্ছেমতো টাকা হাতিয়ে নিলেও দেখার কেউ নেই।
পোড়া তেল যদি খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে, সে ক্ষেত্রে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে জানিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আবদুল আলীম বলেন, অসচেতনতায় পোড়া তেলের খাবার খেয়ে শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি লোকজনের অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে। এ ছাড়া পোড়া তেল নদীতে গেলে পরিবেশ ধ্বংস হয়, মারা যায় মাছসহ নানা সামুদ্রিক প্রাণীও। এ কারণে বাজারে খোলা পাম তেল, সয়াবিন তেল এবং পোড়া তেল বিক্রি নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-