অনলাইন ডেস্ক
এ এক অকল্পনীয় ফাইনাল! যে দুই তারায় সবুজ ক্যানভাসে ছড়ানোর কথা, তাঁরাই ছড়িয়েছেন। তাঁদের গোলে গোলে লুসাইল হয়ে ওঠে ফুটবলের আনন্দধাম। পঁয়ত্রিশের মেসি জোড়ায় রাঙালে ২৩ বছরের এমবাপ্পে করেছেন হ্যাটট্রিকের বিস্ফোরণ। তাতে ১২০ মিনিটের ম্যাচে ৩-৩ গোলের সমতা।
শেষে টাইব্রেকারে গোলরক্ষক ইমি মার্তিনেজের কৃতিত্বে আর্জেন্টিনা ৪-২ গোলে ফ্রান্সকে হারিয়ে মেসির বিশ্বকাপকে সফল করে তোলে। ৩৬ বছর পর আকাশি-সাদার তৃতীয় শিরোপার সঙ্গে সঙ্গেই যেন পূর্ণতা পেয়েছে খুদে জাদুকরের অবিশ্বাস্য ফুটবল ক্যারিয়ার। শেষমেশ মেসির বিশ্বকাপেই ইতি ঘটল কাতার ফুটবল মহাযজ্ঞের।
লুসাইল স্টেডিয়াম ভেসে গেছে আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীতের আবেগে। আর্জেন্টাইনরা তো বটেই, এই কদিনে তার সুরটা কণ্ঠে ধারণ করে ফেলেছেন kalerkanthoঅনেকে। প্রায় সবার কণ্ঠে যখন এই গীত, তখন পুরো স্টেডিয়ামে তৈরি হয় এক জাদুকরী পরিবেশ। সে এক দৃশ্য বটে। বুক ফুলিয়ে, গলা ফাটিয়ে, গাওয়া সেই সংগীতের সঞ্জীবনী যেন লুসাইল ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে সারা বিশ্বের মেসি ভক্তদের কাছে। তাদের কাছেও পৌঁছে যায় লিওনেলে মেসির জাগরণী বার্তা। এটা জাদুকরের জাগরণের বিশ্বকাপ। এই মহাযজ্ঞের মহামঞ্চে এ রকম আগে কখনো হয়নি। বিশ্বকাপের আগে কেউ শিরোপার রং ধরতে পারত না। শিরোপার কথা বলতে পারত না উঁচু গলায়। কিন্তু এবার যেন দিব্যদৃষ্টি খুলে গিয়েছিল সবার। মানুষের মুখে মুখে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ‘মেসির বিশ্বকাপ’। বাস্তবেও তা-ই হতে যাচ্ছিল। মিলিয়ে দিয়েছিলেন ফুটবল জাদুুকর তাঁর অবিশ্বাস্য জাদুকরীতে। কিন্তু তাঁরই উত্তরসূরি কিলিয়ান এমবাপ্পে সেটা ঠেকিয়ে দিয়েছেন। এই ফরাসি তারকার হ্যাটট্রিকে ৩-৩ গোলের সমতা ১২০ মিনিট পর্যন্ত। টাইব্রেকারে ইমি মার্তিনেজ ফিরিয়ে দেন কোমানকে আর সোয়ামেনি মারেন বাইরে। তাতেই ৪-২ গোলে টাইব্রেকার জিতে ৩৬ বছর পর শিরোপার মঞ্চে পৌঁছে আর্জেন্টিনা, সঙ্গে লিওনেল পৌঁছে যান ফুটবলানন্দের সপ্তম স্বর্গে। সেখানে ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে করমর্দন করে হয়তো বলছেন, ‘এখন আর কোনো তফাৎ নেই !’ তফাৎ একটাই, ডিয়েগো শিরোপা জিতিয়েছিলেন আর্জেন্টিনাকে আর লিওনেল জিতিয়েছেন পুরো ফুটবলবিশ্বকে।
আজ বাংলাদেশ ভাসছে আর্জন্টিনা সমর্থকদের মহা মিছিলে। মেসির পায়ে শিরোপার গৌরবে যেন তারাও অংশীদার! বিশ্ব ফুটবলের বড় একটা অংশই এভাবে আপন করে নিয়েছে আর্জেন্টাইন জাদুকরকে। তাদের সেই ভালোবাসা এবং বিশ্বকাপ প্রার্থনা বৃথা যেতে পারে না। ফ্রান্স ফুটবল যতই ফুটবল শক্তির ভাণ্ডার হোক, সেখানে একজন লিওনেল মেসি নেই। যিনি পুরো দলকে খাদের কিনার থেকে টেনে তুলে নিয়ে যেতে পারেন ফাইনালের মহামঞ্চে। সৌদি আরবের কাছে প্রথম ম্যাচে ধাক্কার পর এই মহামঞ্চ অকল্পনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রুপের বেড়া টপকাতে পারে কি না, সেটাই ছিল বড় সংশয়। এরপর প্রতিটি ম্যাচকে ফাইনাল ভেবে সেই দলকে তুলে নিয়েছেন ফাইনালের মহামঞ্চে।
এরপর আর্জেন্টিনার হয় দলীয় বিস্ফোরণ। ফাইনালেই বোধ হয় একটা দল হয়ে ফুটবলের দুর্দান্ত প্রদর্শনী করেছে তারা। ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচটি শুরু করে তারা অবিশ্বাস্য দাপটে। এর আগে কোনো ম্যাচে দেখা যায়নি তাদের পায়ে এমন ছন্দ এবং এত আত্মবিশ্বাস। তাদের দাপটে, কীর্তিতে ফ্রান্স ফুটবলের তারাভরা আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল কালো মেঘে। লিওনেল মেসি শুরু থেকে চেষ্টা করেন চোট সারিয়ে দলে ফেরা দি মারিয়ার সঙ্গে তালমিল করে গোলের আয়োজন করতে। ১৫ মিনিটে থিও হার্নান্দেজ বল হারালে দি মারিয়ার সামনে সুযোগ আসে বক্সের ভেতর। এই উইঙ্গার উড়িয়ে মেরে নষ্ট করেন সেই সুযোগ। কয়েক মিনিট বাদে জিরুর হেস ক্রসবার উঁচিয়ে যাওয়ার ফ্রান্সের একটু তেজ দেখা যায়। কিন্তু ২০ মিনিটে বড় ভুল করেন উসমান দেম্বেলে। বাঁ দিকে ফাউল করেন দি মারিয়াকে আর পোলিশ রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজাতে কোনো দেরিই করেননি। ২৩ মিনিটে মেসির পেনাল্টি গোলে আর্জেন্টিনার মহা-আলোড়ন শুরু হয়। বিশ্বকাপে তাঁর গোল সংখ্যা বেড়ে হয় ১২। তবে নক আউটে শেষ ষোলো থেকে ফাইনাল পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচে গোল করা একমাত্র ফুটবলার তিনি।
সেই গোলের পরও খেলায় ফেরার কোনো লক্ষণ নেই ফরাসিদের খেলায়। ৩৫ মিনিটে দারুণ সুন্দর গোলটির সূচনা হয় আর্জেন্টিনার সীমান্তে। ফরাসি ডিফেন্ডার বল হারানোর পর সেখান থেকেই শুরু হয় প্রতি-আক্রমণ। মেসির দারুণ এক ফ্লিকে ডান দিকে ম্যাক অ্যালিস্টারের সামনে খোলা জমিন। বল নিয়ে ছুটে গিয়ে বাঁ দিকে ফাঁকায় তুলে দেন দি মারিয়ার পায়ে। তাঁর বাঁ পায়ের ফিনিশে আর্জেন্টিনা শিরোপার সুঘ্রাণ পেতে শুরু করে। প্রথমার্ধেই ম্যাচটা এভাবে একপেশে হয়ে যাবে, সেটা কেউ ভাবেনি।
তবে দেশমের মাথায় ছিল অন্য চিন্তা। বাকি ৪৫ মিনিট ঝড় দেওয়ার পরিকল্পনা করেই বিরতির আগে আগে তুলে নেন জিরুদ ও উসমান দেম্বেলেকে। তাঁদের জায়গায় নামেন মার্কাস থুরাম ও কলো মুয়ানি। দুজন নামতেই খেলার ধারা কিছুটা বদলাতে শুরু করে। এর পরও ৫৯ মিনিটে খেলাটা শেষ করে দিতে পারতেন মেসি। বক্সের ভেতর থেকে তাঁর শট বাইরে যাওয়ায় সেটা হয়নি। ৭৮ মিনিটে গিয়ে খেলা বদলে যায় ওতামেন্দির ফাউলে। এই ডিফেন্ডার কলো মুয়ানিকে ফাউল করলে ৮০ মিনিটে এমবাপ্পের পেনাল্টি গোলে ফ্রান্সের ম্যাচে ফেরা শুরু হয়। ঠিক পরের মিনিটে এই ফরাসি তারকার পায়ে আরেক ম্যাজিকে বদলে যায় ম্যাচের পুরো সুর। বক্সের ডান দিক থেকে কোনাকুনি শটে ইমি মার্তিনেজকে পরাস্ত করে ফ্রান্স ম্যাচে ফেরে সদর্পে। মেসির পাল্টা দেওয়ার জন্য যেন তৈরি হয়েছিলেন। তাতেই ফাইনালটা হয়ে ওঠে রোমাঞ্চকর।
সেটি গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেও আছে দুই তারকার চমক। লিওনেল মেসি ১০৭ মিনিটে চমকে দেন আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নিয়ে। লাউতারো মর্তিনেজের শট গোলরক্ষক ফিরিয়ে দেওয়ায় ফিরতি বলটি মেসির পায়ে জালে পৌঁছালে আবার ম্যাচ হেলে পড়ে আর্জেন্টিনার দিকে। কিন্তু ১১৬ মিনিটে সেই এগিয়ে যাওয়া থমকে দেন এমবাপ্পে। তাঁর শট মন্টিয়েল হাত দিয়ে ঠেকালে রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজান। এমবাপ্পের সফল পেনাল্টি গোলে খেলায় ফেরে ৩-৩ গোলের সমতা। এরপর টাইব্রেকারে মেসির বিশ্বকাপে সিলমোহর মেরে দেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক ইমি মার্তিনেজ।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-