আবদুর রহমান •
দুঃখ-কষ্ট যেন সাগর পাড়ের মানুষের নিয়তি। মনোয়ারা বেগমের নিয়তিও ঠিক তেমনি ছিল। সাত বছর আগে উন্নত জীবনের তাগিদে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানো স্বামী মো. নুর বেঁচে আছে কিনা এখনোও জানা নেই তাঁর। এর মধ্য জলবায়ুর প্রভাবে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পাড়ায় বাস্তুহারা হন তাঁর পরিবার। নি:স্ব হয়ে সন্তানদের নিয়ে অন্যত্রে ঠাঁই হলেও কষ্টের শেষ ছিল তাদের জীবনে।
একদিন পাশের বাড়ির আমিনা খাতুনের সহতায় আলট্রা-পুওর গ্রেজুয়েশন (ইউপিজি) প্রোগ্রামের সদস্য হন মনোয়ারা। সে ব্র্যাকের সহতায় সেখান থেকে ঋণ নিয়ে সাগর পাড়ে শুটকি ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে বনে যায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এরপর ঘুরে দাঁড়ায় তাঁর জীবন।
সম্প্রতি শাহপরীর দ্বীপে সরেজমিনে দেখা যায়, ব্র্যাকের ইউপিজি সহতায় ক’জন নারী নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অনুকরণীয় গল্প তৈরি করেছেন। তাদের মধ্য দ্বীপের পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম-একজন। মনোয়ারা এলাকায় এখন শুটকি সওদাগর হিসেবে পরিচিত।
এক প্রশ্নের জবাবে মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ভাইরে; জীবনে অনেক কষ্ট করছি। দুই বেলা খাওন জোটেনি। অন্যর ঘরে সারাদিন কাজ করে পেতে ভাত দিতে হয়েছিল। এক কাপড়ে মাস-বছর পার করেছি। তার উপর ঘর হারিয়ে একবারেই নি:স্ব হয়ে যায়। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাইতে পারতাম না। সেই যে কি দুঃখের দিন গেছে! এখন আর ওই অবস্থা নাই। ব্র্যাকের সহতায় জীবন বদলে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমে এনজিও থেকে জানতে চাওয়া হয়, কি ব্যবসা চালু করব। যেহেতু সাগর পাড়ে আমাদের জীবন, তাই আমি মাছ ব্যবসাকে বেছে নিয়। এরপর প্রথমে ওই এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের কাছ থেকে ছুরি মাছসহ ভিবিন্ন ধরনের মাছ ক্রয় করি। এরপর সেগুলো ভাল করে পরিস্কার করে রোধে দিয়ে শুটকি বানানো হয়। পরে সেগুলো বাজারে ত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি করি। এভাবে ব্যবসাকে আস্ততে আস্ততে বড় করি। এখন আমার শুটকি মাছ বড় বাজারসহ কক্সবাজারেরও বিক্রি হয়। এই কাজে আমার দৈনিক ৪-৫ জন নারী মজুরী কাজ করেন। এছাড়া ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ জমিতে ধানের চাষও রয়েছে আমার। এখন আমরা খাইতে পারি, পরতে পারি, বাচ্চাগুলোও স্কুলে যায়। আগে লোকেরা নানা কত কথা কইলেও এখন সন্মান দেয়।’
মনোয়ারা আরো বলেন, ‘ওই সংস্থা থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ রয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে এখন আমার দেড় লাখের উপরে পুঁজি আছে। আমি একজন শুটকি উদ্যোক্তা হতে চায়। ইচ্ছা আছে আমার শুটকি যাতে চট্রগ্রামে আছাদগঞ্জ বাজারে বিক্রি করতে পারি। সেই লক্ষ্য আমি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।’
দ্বীপের বাসিন্দারা জানায়, পুরুষদের চেয়ে দ্বীপে নারীদের জীবন অনেক বেশি মানবেতর। অধিকাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৪-১৫ বছর বয়সে। তারপর বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই করতেই স্বামীরা আরেক বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। আবার অনেকে উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। তারপর দু’তিন সন্তানের দায়িত্ব বর্তায় এই নারীদের ওপর। পুরুষরা এখানে-সেখানে ঘুরে টুকটাক কিছু করে নিজেদের জীবন চালিয়ে নেন; কিন্তু নারীদের সে সুযোগ নেই। সন্তান নিয়ে তাদের জীবন যেন সাগরে নিমজ্জিত হয়। ফলে নিরুপায় হয়ে পুরুষের মতো ক্ষেত-খামারে কাজ করে তাদেরও জীবন নির্বাহ করতে হয়। দ্বীপে এই পিছিয়ে পড়া নারীদের ক’জন নারী ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্রেজুয়েশন (ইউপিজি) প্রোগ্রামে অংশীদার হয়ে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। পাল্টে দিয়েছেন অন্ধকার পর্ব। তারা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অন্যদেরও। এই নারী উদ্যোক্তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রোজিনা আক্তার। সে টেকনাফের উপকূলীয় এলাকা শাহপরীর দ্বীপ মাঝের পাড়ার মো. ইলিয়াছের স্ত্রী।
রোজিনা জানান, এই নারীরা ছিলেন নিতান্তই হতদরিদ্র। ক’জনের স্বামী বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। এক কড়া জমিও ছিল না তাদের। অন্যের ক্ষেতে কাজ করে দিন কাটত তাদের। এই নারীরা বিশ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে বছর দুই আগে গরু মোটাতাজাকরন ও হাঁস-মুরগিসহ চাষবাদ শুরু করে। শুরুতে তাদের সহায়তা করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘আমরা কাজ করি।’ এরপর কঠিন সংগ্রাম করে তারা সেই পুঁজি দাঁড় করিয়েছেন এক লাখ টাকায়। এখন নিজেদের অভিজ্ঞতায় যে যার মত করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।’
“মাল্টি-সেক্টরাল ইমার্জেন্সি এসিস্ট্যান্ট ফর রোহিঙ্গা প্রোজেক্ট ইন কক্সবাজার, বাংলাদেশ”-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মাদ কায়সার পারভেজ জানান, ”তাদের সংস্থা দ্বীপবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ও স্থিতিশীল কৃষি ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা গড়ে তুলতে কাজ করছে। সমাজে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক ক’জন নারীকে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমাদের পক্ষ থেকে এই নারীদের প্রাথমিক পুঁজি দেওয়া হয়। এই নারীরা প্রথম বছরেই ভালো লাভ পেয়েছেন। পরের বছর এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরও ক’জন।
তিনি জানান, ‘ইউএনএইচসিআর এর অর্থায়ানে ২০১৮-২২ থেকে পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফে ১০টি ইউনিয়নে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত ৪ হাজার ২৮টি অতিদরিদ্র পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে বসতবাড়িতে সবজি চাষ, কৃষি, হাঁসমুরগি ও গবাদি পশু (গরু, ছাগল পালনে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এন্টারপ্রাইজ অনুযায়ী সম্পদ হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া ২ হাজার গ্র্যাজুয়েট সদস্য নিয়ে মার্কেট লিংকেজ ইনিসিয়েটিভ অব্যাহত রয়েছে যার মূল উদ্দেশ্য হলো সদস্যদেরকে অর্থনৈতিকভাবে আরও বেগবান করা এবং টেকসই উন্নয়নে বাজার ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত করা।’
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘শাহপরীর দ্বীপের অতিদরিদ্র বেশ কিছু নারী ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্রেজুয়েশন (ইউপিজি) প্রোগ্রামে অংশীদার হয়েছে। আমরা তাদের কিভাবে বিষমুক্ত মাছ রাখা যায়, সেটি প্রশিক্ষন দিয়েছে। এছাড়া অনেকে মাছ জাতকরন বিষয়েও ধারনা দেওয়া হয়েছে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে চলতি বছরে ব্র্যাকে আলট্রা-পুওর গ্রাজুয়েশন প্রোগ্রামে ২ হাজার অতিদরিদ্র পরিবার অংশীদার হয়েছেন। এর মধ্য উখিয়ায় ১২৩৮টি এবং টেকনাফে ৭৬২টি পরিবার এ প্রকল্পের আওতাধীন। এর আগে ২০০৯ সালে আলট্রা-পুওর গ্রাজুয়েশন প্রোগ্রামের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জেলার ২২ হাজার ৩১৬টি অতিদরিদ্র পরিবার ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের আওতায় এসেছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-