প্রথম আলো •
কক্সবাজারের টেকনাফ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ১০১ ইয়াবা কারবারি ও পৃষ্ঠপোষক আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
আশা করা হয়েছিল, এর মাধ্যমে টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তে মাদক চোরাচালান কমবে। কিন্তু ২ বছর ৯ মাস আগের ওই আত্মসমর্পণের ঘটনায় কোনো ফল হয়নি বলে মনে করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। পরিসংখ্যান বলছে, মাদকের চোরাচালান আগের চেয়ে বেড়েছে।
গত বুধবার কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আত্মসমর্পণকারী ওই ১০১ জনকে দেড় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। রায় ঘোষণার সময় আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন মামলার ১৮ আসামি। অবশিষ্ট ৮৩ জন পলাতক।
পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির চার ভাই আবদুল শুক্কুর, আবদুল আমিন ওরফে আমিনুল ইসলাম, মো. ফয়সাল, শফিকুল ইসলাম; চাচাতো ভাই মো. আলম; খালাতো ভাই মং মং সিং; ফুফাতো ভাই কামরুল ইসলাম; ভাগনে সাহেদুর রহমানসহ ১২ জন নিকটাত্মীয়।
কক্সবাজারে মূলত বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে ইয়াবা উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়। সরকারের এই সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে কক্সবাজারে ১ কোটি ২৮ লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০১ ইয়াবা কারবারি ও পৃষ্ঠপোষক আত্মসমর্পণ করেন।
ওই বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ১ কোটি ৭৭ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। পরের বছর সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ২ কোটি ৩৯ লাখে। গত বছর ২ কোটি ৫৯ লাখ ৬৭ হাজার ৯৫০ ইয়াবার পাশাপাশি ২৩ কেজি ৮০২ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস) উদ্ধার করা হয়। আর চলতি বছরের ১০ মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ ইয়াবা ও ১৯২ কেজির বেশি আইস। ১৮ নভেম্বর উখিয়ার পালংখালীর রহমতের বিল গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করে বিজিবি।
নাগরিক সমাজের অভিমত
মাদকের বড় কারবারিদের লঘুদণ্ডে ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ব্যবসায়ী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলছেন, মাদক চোরাচালান আগের তুলনায় আরও কয়েক গুণ বেড়েছে। কারাগার থেকে বেরিয়েও তাঁরা শুদ্ধ হননি। তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা জরুরি ছিল।
রায় ঘোষণার পর কক্সবাজার আদালত থেকে টেকনাফের আলোচিত মাদক ও অস্ত্র মামলার ১৮ আসামিকে কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ। বুধবার দুপুরে
ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ করিয়ে কার লাভ হলো—প্রশ্ন তুলেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) টেকনাফ শাখার সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ইয়াবা কারবারি ও পৃষ্ঠপোষকদের জন্য টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দুই শতাধিক নারী-পুরুষ নিহত হয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন বাবা-ভাই, কেউ হারিয়েছেন স্বামী-সন্তান। মাদক চোরাচালান এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। যাঁরা আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়নি। এখন মাদকের টাকায় অনেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ১০১ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেছিলেন নিজেদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে। তাঁরা যখন কারাগারে বন্দী ছিলেন, তখন তাঁদের চক্রের সদস্যরা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। এখন গডফাদারদের অনেকে সরাসরি অথবা রোহিঙ্গার মাধ্যমে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছেন। ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণ করায় সমাজ ও সাধারণ মানুষের কোনো লাভ হয়নি, বরং আত্মসমর্পণকারীরা নানাভাবে লাভবান হচ্ছেন।
কেন কমছে না চোরাচালান
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল মো. মেহেদী হোসাইন কবির বলেন, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে বিজিবি কঠোর ও তৎপর রয়েছে। যে কারণে আগের তুলনায় মাদকদ্রব্য উদ্ধার হচ্ছে বেশি। এরপরও দুর্গম সীমান্ত দিয়ে রাতের বেলায় মাদক চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি আবদুল হালিম মনে করেন, চাহিদা কমানো গেলে মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আসত। এ ক্ষেত্রে জনগণের সচেতন হওয়া দরকার।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-