আবদুর রহমান •
মিয়ানমার সীমান্তের উপকূলীয় উপজেলা টেকনাফে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় ও ক্ষতিগ্রস্থের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঝুঁকি ও ক্ষতি কমাতে উদগ্রীব দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল দুটির যুব এবং নারী সংগঠনগুলোর স্থানীয় নেতারা।
জলবায়ু অভিযোজন প্রক্রিয়ায় এখানকার যুব ও নারী সমাজের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী যুবলীগ ও মহিলা লীগ এবং তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির যুবদল ও মহিলা দল স্থানীয় পর্যায়ে এ বিষয়ক সক্ষমতা ও তৎপরতা আগামীতে আরো বাড়ানোর কথাও বলেছে। অন্যথায় সামনে দিনগুলো ভয়াবহ রুপ ধারন করবে।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বেড়েই চলেছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। আর সে কারণে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো এবং ডুবছে দ্বীপের অনেক অংশ, উদ্বাস্তু হচ্ছে অনেক মানুষ। গত চার বছরে সেন্টমার্টিন-শাহপরীর দ্বীপে প্রায় পাচঁ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যত্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া আশঙ্কাজনক হারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার পাশাপাশি পানিতে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে পানিতে ৯ গুণ বেশি লবণাক্ততা পাওয়া যাচ্ছে এ উপকূলে। এতে লোকজন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এমনকি অনেক টিউবওয়েলে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা দেখছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নুরুল আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, “যে কোনো দূর্যোগ মোকাবেলায় যুব ও তরুণ সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সামলাতে আমরা উদ্যোমীদের অংশগ্রণ নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছি।”
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর যুবকদের সরকারের ঘূর্ণিঝড় প্রস্ততি কর্মসূচির (সিপিপি) সাথে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে উল্লেখ করে আলম আরো বলেন, “স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তাঁরা ঘুর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দূর্যোগময় পরিস্থিতিতে আক্রান্তদের পাশে থেকে সহযোগিতা করে থাকে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি প্রশমণে স্থানীয় পর্যায়ে যুব ও তরুণ সমাজের সম্পৃক্ততা ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ দাবি করে টেকনাফ উপজেলা যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ কাইয়ুম বলেন, “বিরোধী দল হওয়ায় ইচ্ছা থাকলে হওয়ায় আমরা অনেক সময় বিভিন্ন কাজে অংশ নিতে পারি না। তবে আমরা এলাকা ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরী শুরু করেছি।” এই সেচ্ছাসেবকরা আগামী আরো বেশি সক্রিয় হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
টেকনাফের এই দুই যুবনেতার ভাষ্যানুযায়ী, উপকূলীয় সীমান্তের এই উপজেলায় গত কয়েক বছরে ভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে মানুষ উদ্বাস্তু হতে শুরু করেছে। বিশেষত দ্বীপগুলোতে বেড়েছে ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনজনিত নানা প্রতিবন্ধকতা। বাড়ছে পানিবাহিত রোগও। ‘
এই পরিস্থিতিতে জলবায়ু অভিযোজন প্রক্রিয়ায় উপকূলীয় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও জরুরি বলে মনে করেন টেকনাফ উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান তাহেরা আক্তার মিলি।
এই নারী জনপ্রতিনিধি বলেন, “টেকনাফে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। তাই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা যুব ও নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির চেষ্টা করছি।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচএম নজরুল ইসলাম মনে করেন, স্থানীয়ভাবে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত যুব ও নারীর সংখ্যা বাড়াতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের যুব ও নারী সংগঠনগুলোর তৃণমূল নেতৃত্ব কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, “এ কাজে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়লে স্থানীয়রা নিশ্চিতভাবেই উপকৃত হবে।”
জেলা মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিলি বলেন, “জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ের শিকার হওয়া এলাকাগুলোয় যুব ও নারী স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে তাদের মাধ্যমে আমরা এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি।পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করছি।”
“তবে শুধু এটুকুই যথেষ্ট নয়,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জলবায়ু অভিযোজন প্রক্রিয়ায় উপকূলীয় যুব সমাজ ও নারীদের আরো সম্পৃক্ত করতে সরকারিভাবে বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।”
এ ব্যাপারে সরকার দলীয় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আলমের ভাষ্য, সেচ্ছাসেবকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগসহ দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো.এরফানুল হক বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক মোকাবেলায় প্রভাব মোকাবেলায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে যুব ও নারী সমাজের সম্পৃক্ততা বাড়ানো হচ্ছে। তাদের মাধ্যমে আমরা পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনা বৃদ্ধি করছি। আশাকরি, উপকূলী অঞ্চলগুলো এর সুফল পাবে। এতে ক্ষতির পরিমান কমে আসবে। পাশাপাশি সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্নবাসনসহ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
সরকারি-বেসরকারি সংস্থার জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক অনেক দৃষ্টিভঙ্গী ‘তৃণমূল বিচ্যুত’ ও ‘বাণিজ্যিক’ বলে উল্লেখ করেন পরিবেশ কর্মী ও নাগরিক নেতা নজরুল। তাঁর ভাষ্য, এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক লাভের চিন্তা না করে সবাইকে সমৃক্ত করে প্রকৃত অভিযোজন কৌশল প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় মোকাবেলায় স্থানীয়পর্যায়ে যুদ্ধের মতো প্রস্তুতি নিতে হবে।”
উল্লেখ্য, মিশরের শারম আল শাইখে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৭) শেষ সপ্তাহের শুরুতে গত সোমবার বাংলাদেশ পরিবর্তন সহনশীলতা বা অভিযোজনের জন্য তহবিল দ্বিগুন করার দাবি জানিয়েছে।
সম্মেলনের তুলে ধরা ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান বা জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০৫০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার বা পঁচাশি হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনতি সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ উল্লেখ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, “২৭ বছরের জন্য মোট ২৩০ বিলিয়ন ডলার দরকার হবে।”
এছাড়া সম্মেলনের এক আলোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশের দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-