নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম •
চট্টগ্রামে নানা কৌশলে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। এর পেছনে রয়েছে এক শ্রেণির অসাধু জনপ্রতিনিধি ও নির্বাচন অফিসের কিছু কর্মী। তাদের সঙ্গে যোগসাজসেই রোহিঙ্গারা হয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশি, পাসপোর্টে নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের নানা দেশে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ও নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে এমন বহু অভিযোগ উঠেছে। এমন কাজে জড়িত রোহিঙ্গা, দালাল ও নির্বাচন অফিসের কর্মীসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
নির্বাচন অফিসের কর্মীদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেয়ে পাসপোর্টের আবেদন করছেন, এমন বিষয়টি প্রথম উঠে আসে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর সাবেক (চাকরিচ্যুত) উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনের তদন্তে।
শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস থেকে ১৭২টি আবেদন ফরম এনেছিলাম। যাদেরকে রোহিঙ্গা বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। একইভাবে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকেও ৫০/৬০টি আবেদন ফরম এনেছিলাম। এসব আবেদনকারীরা রোহিঙ্গা বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। ঢাকা, বান্দরবান, ফেনীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে রোহিঙ্গা সন্দেহে অসংখ্য আবেদন জব্দ করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা প্রথমে এনআইডি পায়। এরপর এনআইডি ব্যবহার করে তারা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করছে। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্টের এসব আবেদনের প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছিলাম। তবে শেষ করতে পারিনি। এখন ওইসব তদন্ত ডিপ ফ্রিজে। তারা রোহিঙ্গা হলেও অনেক প্রভাবশালী। এসব অনিয়মের সঙ্গে আপস না করায় আমাকে চাকরি হারাতে হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিস সূত্র জানায়, পাসপোর্ট আবেদনে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অথবা স্মার্ট কার্ডের ফটোকপি, পরিচয়পত্রের মূলকপি অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রদর্শন করতে হবে। অপরদিকে ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য জন্ম-নিবন্ধন সার্টিফিকেট, বাবা-মায়ের ছবি ও এনআইডির ফটোকপি জমা দিতে হয়। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক নাগরিকত্বের সনদও লাগে। টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গারা এসব কিছু ম্যানেজ করেই তারা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করছে।
পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা জানান, পাসপোর্টের আবেদনে আঙুলের ছাপ নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া যুক্ত রয়েছে। ওই প্রক্রিয়ায় আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর আবেদনকারী ব্যক্তি যদি রোহিঙ্গা হয় এবং তার ডাটা রোহিঙ্গাদের তথ্য ভাণ্ডারে থেকে থাকে তাহলে ধরা পড়বে।
এমন ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস গত কয়েক বছরে এক দালালসহ ১০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা পরিচয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেন।
গ্রেফতারদের মধ্যে রয়েছেন হাটহাজারী উপজেলার পশ্চিম ধলই এনায়েতপুর এলাকার সুমাইয়া আক্তার, সীতাকুণ্ডের জঙ্গল লতিফপুরের জাফরাবাদ এলাকার মো. ফয়সাল, ফটিকছড়ির আব্দুল্লাহপুর ফতেপুরের শফিউল হাইর, হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ ফরহাদাবাদ এলাকার জেসমিন আক্তার, হাটহাজারী কাটিরহাট সোনাগাজী তালুকদারের বাড়ির ফাতেমা ইয়াসমিন, রাঙ্গুনিয়া উত্তর পদুয়া এলাকার পূর্ব খুরুশিয়ার সিরাজ খাতুন, সন্দ্বীপ বাউরিয়া মোহা. ইসলামের বাড়ির মারজিয়া আক্তার, সন্দ্বীপ হরিশপুর এলাকার মোহাম্মদ আরমান, সীতাকুণ্ডের সলিমপুর জাফরাবাদ এলাকার জোবাইদা খানম ও বাকলিয়া চকবাজার কে বি আমান আলী সড়কের দিল মোহাম্মদ। এসব রোহিঙ্গারা টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে থাকার কথা থাকলেও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্ট ও সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেনা অভিযান শুরু হলে বাংলাদেশ সীমান্তে শরণার্থীদের ঢল নামে। এরপর কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নেওয়া লাখো রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের উদ্যাগ নেয় সরকার।
বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতেও তাদের বায়োমেট্রিক কাজে লাগানোর পরামর্শ ছিল নির্বাচন কমিশনের। অটোমেটিক ফিঙ্গার আইডেন্টিফিকেশন (এএফআইএস) সাপোর্ট সার্ভিসের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার শনাক্ত করা সম্ভব। একইভাবে রোহিঙ্গা শনাক্তে এটি ব্যবহার করছে পাসপোর্ট অফিস।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. আবু সাইদ বলেন, চলতি বছরের ২৩ মে পাসপোর্টের জন্য জোবাইদা খানম নামে এক তরুণী আবেদন করেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের ঠিকানা ব্যবহার করে তিনি আবেদন করেন। আবেদনে পিতার নাম সৈয়দ নূর, মায়ের নাম সালেমা বেগম উল্লেখ করে, জন্মসনদ এবং তার মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র ও নাগরিকত্ব সনদ দাখিল করেন জোবাইদা। আবেদনকারী তরুণীর কথাবার্তায় সন্দেহ হলে তার আঙুলের ছাপ যাচাই করে দেখা যায় তিনি জুরাইয়া বিবি।
২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার নিবন্ধন হয়। তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর। এভাবে বাকিদেরও আটক করা হয়।
পরিচালক আরও বলেন, ‘গত কয়েক বছরে এক দালাল এবং ১০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। তাদেরকে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
ডবলমুরিং থানার ওসি মো. সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিস থেকে যেসব ব্যক্তিকে আমাদের কাছে সোপর্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।’
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, কতিপয় দালাল চক্রের সহায়তায় টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমাদের পাওয়া তথ্যমতে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ করেই রোহিঙ্গারা এনআইডি পেয়ে যাচ্ছে। পরে এনআইডি ব্যবহার করে পাসপোর্টে আবেদন করছেন তারা। গত ২৫ অক্টোবর নগরীর হালিশহর হাউজিং এস্টেট উচ্চবিদ্যালয় থেকে দশ সদস্যের একটি চক্রকে গ্রেফতার করা হয়। এরমধ্যে দুই রোহিঙ্গা, তিন দালাল ও পাঁচ জন নির্বাচন কমিশনারের (ইসি) অস্থায়ী ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ছিল। এমন কাজ যাতে না হয় সে জন্য পুলিশ সতর্ক রয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-