সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিচরণে গ্যাঁড়াকলে ১২ লাখ রোহিঙ্গা

রফিকুল ইসলাম •

অধিকার প্রতিষ্ঠার সব প্রচেষ্টা যেন ক্রমেই ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক নানা সংকটে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তাও উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসছে। নো-ম্যানস- ল্যান্ডে তাড়া খেয়ে ক্যাম্পগুলোতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দাপুটে বিচরণসহ নানাবিধ সমস্যার গ্যাঁড়াকলে পড়েছে বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১২ লক্ষ মিয়ানমার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা মুসলিম।

২০১৭ সালের আগস্ট থেকে আশ্রিত ও তাদের ঔরসে জন্ম নেয়া এবং এরও আগে থেকে আশ্রিত প্রায় ১২ লক্ষাধিক মিয়ানমার নাগরিক রোহিঙ্গার অবস্থান বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। এসব রোহিঙ্গারা ক্রমশঃ পড়েছে চরম সংকটের ঘূর্ণাবর্তে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অভিমত এখানকার (আশ্রয় ক্যাম্পে) চেয়ে মিয়ানমারে অনেক নিরাপদ ও ভাল ছিলাম।

রোহিঙ্গাদের একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের সহিংসতা প্রতিনিয়ত তাড়া করছে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের। গত কয়েক বছরে তারা অনেক রোহিঙ্গাকে অপহরণ করেছে, একই সময়ে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডও বেড়েই চলেছে। একটা বিদেশি সেবা সংস্থায় কর্মরত রোহিঙ্গা সেবাকর্মী আসুমা খাতুন বলেন, আমরা কোথাও নিরাপদ নই। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে আতঙ্কের নাম ওই সংগঠনটি।

রাখাইনের একটি মাধ্যমিক স্কুলের সাবেক শিক্ষক রশিদুল আলম বলেন, যারা ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের একাধিক সুসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিল। তারাই মুলত কোন পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আক্রমণ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে নৃশংসতার প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা নিজেদেরকে রোহিঙ্গাদের মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করলেও বাস্তবে তারা বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পের স্বজাতি রোহিঙ্গাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক হুমকি।

উখিয়ার একটি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মা অংহ্লা সোয়ে (৪৫) যে কোনো মুহূর্তে তার স্বামীকে হারানোর আশঙ্কা করছেন। রোহিঙ্গাদের এ শিক্ষক ও অধিকার কর্মী বলেছেন ওই গ্রুপটি তাকে এবং তার স্বামীকে হুমকি হিসেবে দেখে।মা অংহ্লা সোয়ে বলেন, তারা ক্যাম্পগুলোতে টার্গেট কিলিং করছে। সে আরো বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করা বন্ধ না করায় তারা আমার স্বামীকে একাধিকবার হুমকি দিয়েছে।

সর্বশেষ ২৬ অক্টোবর রাতে উখিয়ার ১৭ নং ক্যাম্পে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। এর আগে ১৮ অক্টোবর একজন, ২৫ অক্টোবর একজন ও ১৫ অক্টোবর ১৯ নং ক্যাম্পে একইসাথে সন্ত্রাসীরা দুইজন রোহিঙ্গা মাঝিকে (কমিউনিটি নেতা) কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। মূলতঃ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসব খুনাখুনির সাথে ওই সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে সাধারণ রোহিঙ্গা ও সংশ্লিষ্টরা জানান। এ অবস্থায় “রাত যতই গভীর হয় ততই ক্যাম্পে থাকা প্রতিটি রোহিঙ্গার মনে প্রশ্ন জাগে, “আজ রাতে কাকে হত্যা করা হচ্ছে?” জানালেন রোহিঙ্গারা।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সহিংসতার বিষয়ে সতর্ক করছে। ফরটিফাই রাইটস্ এর প্রধান জন কুইনলি তৃতীয় বলেছেন, বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

তিনি বলেছেন, ক্যাম্পগুলোতে সেবাকর্মী হিসাবে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছে তারাও ভয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা কর্মী ও নারীদের জন্য এটা খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি। কিছু কিছু গ্রুপ রোহিঙ্গা কর্মীদের টার্গেট করার সত্যতা স্বীকার করেছেন রোহিঙ্গারাও। মানব পাচার, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আরও সুরক্ষার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।

গ্লোব পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা কিশোরীদের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক রহমত উল্লাহ বলেছেন, ওই সশস্ত্র গ্রুপটি আমাকে চারবার হত্যার হুমকি দিয়েছে। কারণ হচ্ছে রোহিঙ্গা নারীরা শিক্ষিত হোক তা তারা চায় না। আমার স্কুলের একজন শিক্ষার্থীকেও তারা কিডন্যাপ করেছিল।” তিনি বলেন, বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় ওই ছাত্রকে উদ্ধার করা হয়েছে, কিন্তু তিনি এখনও ক্যাম্পে অনিরাপদ বোধ করছেন। “কারণ ওরা তাকে যে কোনো সময় হত্যা করতে পারে,” বলে তিনি জানান।

ক্যাম্পের ভেতরে একটি ছোট মুদি দোকানদার মোহাম্মদ ওমর বলেছিলেন সশস্ত্র গুপটির সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার নখ টেনে বের করেছে। তাদের চাহিত অর্থ দিতে অস্বীকার করায় তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে।

তিনি বলেন, তাদের-এ নির্যাতনের ক্ষত এখনো তার মাথায় রয়েছে। ওমর বলেন, “যখন তারা আমাকে অপহরণ করে, তখন আমার মুক্তির জন্য বাংলাদেশী ৮০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। এখনও আমাকে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে। জানি না আমাকে আরও কত সময় ধরে তা দিতে হবে।”

পিটার সাইফুল নামের একজন রোহিঙ্গা বলেন, শুধু রোহিঙ্গা নারীরাই নয়, অন্য ধর্মে বিশ্বাসী রোহিঙ্গা পরিবারও তাদের ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে হত্যা ও অপহরণ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি বলেন যে ২১ টি রোহিঙ্গা খ্রিস্টান পরিবার ক্যাম্পে বসবাস করছিল, তাদের ১৭ টি পরিবার নিরাপত্তার কারণে এখন অস্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থান করছে। তিনি জানান, তারা কুতুপালাং-এ রোহিঙ্গা খ্রিস্টানদের একমাত্র গির্জাটি ভেঙে দিয়েছে। এটি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। তাদের কাছে ধর্মীয় স্বাধীনতা নেই।”

একাধিক নির্ভরযোগ্য ও রোহিঙ্গা সূত্র জানায়, বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই চলছে। কৌশলগত দূর্বল ওই সন্ত্রাসী গ্রুপটি সেই পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় টিকতে না পেরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনপ্রিয় নেতা মাষ্টার মুহিবুল্লাহ ও একটি মাদরাসায় ৬ জন খুনের পর নানামুখী প্রতিরোধের মুখে আরসা কিছুটা ঘাপটি মেরে ছিল।

সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, উখিয়ার আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে নানা সমস্যায় তাদের সদস্যরা সীমান্তের তুমব্রু নো-ম্যানস-ল্যান্ডে অবস্থান নিয়েছিল। গত জুলাইয়ে মাঝামাঝিতে রাখাইনে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত এএ তাদেরকে সীমান্ত এলাকা থেকে সরে যেতে বলে দেয়। কারণ এএ মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে একা লড়াই করতে প্রস্তুত,তাই সেখানে অন্য কোন সশস্ত্র গ্রুপের অবস্থান মেনে নিতে রাজি নয় বলে জানা যায়। গত দুই মাস ধরে সীমান্তে সশস্ত্র সংঘর্ষের মধ্যে নো-ম্যানস-ল্যান্ডে অবস্হানকারী গ্যাং সদস্যরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং শরণার্থী শিবিরে খুনসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে বলে রোহিঙ্গা, পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান।

এ পরিস্থিতিতে নিজেদের আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে গ্রুপটির সদস্যরা আবারো ক্যাম্পে ফিরে আসে। ক্যাম্পেগুলোতে তাদের তৎপরতা ও বিচরণ বেড়ে গেছে বলে জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্থিতিশীলতার পিছনে সন্ত্রাসী গ্রুপটির কমান্ডার আতা উল্লাহর নির্দেশনায় খালেদ, ফজুল কবির, ক্যাম্প -৯, হামিত @ আবু আনাস @ সুহাইব, ক্যাম্প-৯, এহসান @ নজির আহমেদ, ক্যাম্প -৯, মুস্তাক, ক্যাম্প-১৪, মৌলভী রফিক @ মোহাম্মদুল হোসেন ক্যাম্প-৭, রাহমত করিম, ক্যাম্প -১ /ই (লাম্বাশিয়া), আব্বাস @ কুল্লা মিয়া, ক্যাম্প-৯, নুর বসর, ক্যাম্প-৯, রফিক @ আমির, ক্যাম্প- ৭, শাকের @ ম্যাস, ক্যাম্প -৭,কলিম @ মোঃ সোয়েদ, ক্যাম্প -২, সানা উল্লাহ, ক্যাম্প -৭, নূর আলম, আব্দুল মাবুদ, ক্যাম্প-৭, ইয়াহায়া,ক্যাম্প- ১৩, আমির আহমেদ শাহ, ক্যাম্প-১৪, ফয়সেল, ক্যাম্প-১, লালু, ক্যাম্প-১, হাফেজ আয়ুব, ক্যাম্প-২১ সানা উল্লাহ, ক্যাম্প-১৪, নাজুম উদ্দিন, ক্যাম্প -১, তুহা @ গাজী, ক্যাম্প-৭, মৌলভী জিয়াবুল হক ক্যাম্প -৭,মৌলভী লাল মোহাম্মদ, ক্যাম্প-৮/ ইস্ট, মৌলভী হান্না, ক্যাম্প -৮ /ইস্ট, হাফেজ আয়ুব @ সাইফুল, ক্যাম্প -৯, মুফতি জিয়াবুর রহমান, ক্যাম্প-৫, মৌলভী জামাল, ক্যাম্প-১১, হাফেজ রশিদ উল্লাহ, ক্যাম্প -৩, মৌলভী তৈয়ব, ক্যাম্প -৩, হাফেজ হাশিম, ক্যাম্প -৩, হাফেজ মোঃ আলম, ক্যাম্প-৩, হাসন, ক্যাম্প-৯, হাফেজ ওমর, কয়াম্প -৯, মুজিব, ক্যাম্প -৯, মোহামুদুল্লাহ, ক্যাম্প -৮/ই, এমএসএফ এর স্বেচ্ছাসেবক,আলম, ক্যাম্প-৮/ইস্ট, এমএসএফ এর স্বেচ্ছাসেবক, মৌলভী কামাল, তুমব্রু নো ম্যান্স ক্যাম্প, মৌলভী ফরিদ, ক্যাম্প-৯, মৌলভী আরিফ আহমেদ, নো-ম্যানস-ল্যান্ড, হুবাইব, নো-ম্যানস-ল্যান্ড, আব্দুল আমিন, ক্যাম্প-৩, হামিদ মাঝি, ক্যাম্প-৩,আব্দুল হাসিম @গোরা মাস্টার, ক্যাম্প -৩, মাঝি আবুল বাসার, বসির আহমেদ, ক্যাম্প -৩, খুইল্লা মিয়া, ক্যাম্প -৩,হাফেজ জুবায়ের ক্যাম্প-৩,হাফেজ আবদুল্লাহ, ক্যাম্প -৫, মৌলভী আব্দুল মোন্নাফ, ক্যাম্প -৫, মৌলভী আবদুস শুক্কর, ক্যাম্প-৫, হাফেজ আহমেদ, ক্যাম্প-৫, সোলিম @আবু সালমান ক্যাম্প -৫, মুফতি জিয়াউর রহমান, ক্যাম্প-৫ নাম জানা গেছে।

৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এএসপি ফারুক আহমেদ জানান, তারা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। তিনি জানান, গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে অপরাধ নির্মূলে ‘অপারেশন রুট আউট’ চলমান রয়েছে। শুক্রবার- শনিবার ৪১ জন, রোববার ১৯ জন ও সোমবার রাতে ১৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। এদের ২৮ জনকে মোবাইল কোর্টে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়েছে। অন্যরা হত্যা,ডাকাতি,অপহরণসহ বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামি।

এপিবিএন-৮ এর কমান্ডিং অফিসার আমির জাফর জানান, সম্মিলিত অভিযান অব্যাহত থাকবে। পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক জাফর বলেন, “নো-ম্যানস-ল্যান্ডে কিছু অপরাধী চক্র বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল।” সন্দেহভাজনরা সম্ভবত এআরএসএ, আরএসও এবং ইসলামিক মাহাজের মতো গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। “কিন্তু আমরা বেশিরভাগই অপরাধের সাথে জড়িত বলে এআরএসএর নাম শুনছি। এই অপরাধীরা রাতে ক্যাম্পে ঘোরাফেরা করে।”

আরও খবর