মিয়ানমারে ফিরতে ফের ৫ শর্ত রোহিঙ্গাদের

বিশেষ প্রতিবেদক •

মিয়ানমারে ফিরতে রোহিঙ্গারা ৫টি শর্ত দিয়েছে। শুক্রবার (২১ অক্টোবর) বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা এসব শর্ত গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরেছেন।

শর্তগুলো হচ্ছে- ১. রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থানীয় আদিবাসী এবং সেজন্য তাদের নেটিভ স্ট্যাটাস বা স্থানীয় মর্যাদা সংসদে আইন করে পুনর্বহাল করতে হবে, যার আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি থাকতে হবে। ২. আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ‘সিটিজেন কার্ড’ দিতে হবে। বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে প্রত্যাবাসন করে স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে। একই সাথে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে থাকা রোহিঙ্গাদের সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে স্থানীয় নাগরিকের মর্যাদা দিতে হবে। ৩. রোহিঙ্গাদের তাদের নিজস্ব গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে। ৪. আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সাথে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। ৫. ২০১৭ সালে সংঘটিত গণতহ্যা ও নির্যাতনের বিচার করতে হবে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নারকীয় নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ।

 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, সংস্থার শীর্ষ প্রতিনিধিরা নিয়মিতই দেখতে আসেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প, অনুধাবন করার চেষ্টা করেন উখিয়া- টেকনাফের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবন। দেন নানা আশ্বাস। কিন্তু সেই আশ্বাসেই ঘুরপাক খায় দেশহীন এসব মানুষের ঘরে ফেরার স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত মিয়ানামারকে রাজি করিয়ে ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও তা আর হয়নি। রোহিঙ্গাদের জুড়ে দেওয়া বিভিন্ন শর্তের কারণে তা ভেস্তে গেছে। সুযোগ পেয়ে তাদের ফেরত নিতে নানা তালবাহনা শুরু করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। দীর্ঘদিন পর চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছে দেশটি। তবে আবারও শর্তের জালে প্রত্যাবাসন আটকানোর চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। তারা ফিরতে আগ্রহী, এবারও জুড়ে দিয়েছেন পাঁচটি শর্ত।

রোহিঙ্গারা বলেছেন, ক্যাম্প জীবন থেকে তারা মুক্তি চান। মিয়ানমার তাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। তারপরও একটু শান্তির আশ্বাস পেলেই ফিরে যাবেন। আমরা একজন দু’জন করে নয়, পুরো পরিবার নিয়ে স্বদেশে ফিরতে চাই। যেখানে নাগরিক হিসেবে সব অধিকার থাকবে।

টেকনাফের উঞ্চিপ্রাং ২২ নম্বর ক্যাম্পের মাঝি রফিক বলেন, ‘আমরা আর বাংলাদেশে থাকতে চাই না। আমরা আমাদের দেশে ফিরতে চাই। আর বন্দিজীবন কাটাতে চাই না। বাংলাদেশ সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ করেছে। এই দেশের মানুষ আমাদের যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন সেটি কোনদিন ভুলতে পারবো না। তবে আমাদের প্রত্যাবাসন ঠেকাতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা বিশ্ব নেতাদের সহযোগিতা কামনা করছি’।

উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের হেড মাঝি আমিন বলেন, ‘আমাদের ৫টি দাবি পূরণ করলে আমরা দেশে ফিরবো। তারমধ্যে হল, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বাড়িঘর জমি ফেরত পাবার নিশ্চয়তার মতো বিষয়গুলো। আমরা আর কাঁটা তারের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে চাই না। আমরাও তো মানুষ। আমরা বাংলাদেশে থাকতে আসেনি। আমরাও বুঝতে পারছি বাংলাদেশের অবস্থা। আমরা চীনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি’।

উখিয়া বালুখালী ১১ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা করিম উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের পরিবারে ১৮ জন সদস্য আছে। যেভাবে ভাসানচরে নিয়ে গেছে আমরা সেভাবে যাবো না। একবারে আমাদের পুরো পরিবারকে নিয়ে মিয়ানমার ফিরবো’।

হাবিবউল্লাহ নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, ‘আমরা দেশে ফিরতে রাজি, তবে আমাদের দাবিগুলো মেনে নিতে হবে। দেশে ফেরার আগে আমাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বাড়িঘর জমি ফেরত পাবার নিশ্চয়তা দিতে হবে। না হয় আমরা আবারো নির্যাতনের শিকার হবো। আমাদের যদি জমি, জাতীয়তা না দেয় তাহলে আমরা কি আশা নিয়ে ফিরবো? তাই আমাদের আগে ৫ দফা দাবি পূরণ করতে হবে’।

আরাকান রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস সোসাইটি সংগঠনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবাইর বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠাতে চীনের উদ্যোগ আশা জাগানিয়া। অধিকার নিশ্চিত হলে দেশে ফিরতে আমরা প্রস্তুত। তবে বর্তমান যুদ্ধের মাঝে ফেরত যাওয়া নিরাপদ নয়। এই মুহূর্তে মিয়ানমার খুব উত্তপ্ত।

উখিয়া কুতুপালং ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের কারণে স্থানীয়রা ফসলি জমি, শ্রমবাজার সব কিছু হারিয়েছে। যেভাবেই মাদক ও অস্ত্র পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে যদি দ্রুত প্রত্যাবাসন না হয় তাহলে স্থানীয়দের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে রোহিঙ্গারা।

চীন ১১ লাখ রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক। বিষয়টি আমাদের জন্য ঈদের আনন্দের মতো হলেও কালোছায়া এখনো আমাদের ঘিরে রেখেছে। কারণ এনজিওগুলো রোহিঙ্গারা ফিরে যাক সেটি কখনো চায় না। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর আগে দেশি- বিদেশি এনজিওগুলোর প্রতি প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে। তাছাড়া ৮ লাখেরও বেশি তালিকা থেকে এপর্যন্ত মাত্র ৬০ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে নিজ দেশের বাসিন্দা হিসেবে বাছাই করছে মিয়ানমার’।

আরও খবর