কক্সবাজার জার্নাল ডটকম •
জখমী, ময়নাতদন্ত, ধর্ষণ, বয়স নির্ধারণী প্রতিবেদনসহ স্বাস্থ্যগত সকল প্রতিবেদন তৈরী ও সরবরাহে দায়িত্বশীলতা আর পেশাদারিত্বের সাথে যথাযথ বিধি-বিধান প্রতিপালন এবং অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের জন্য ১২ টি নির্দেশনা প্রদান করেছেন কক্সবাজারের প্রধান জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম (চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট)।
আদেশে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত প্রতিবেদনের অর্থ বুঝতে যাতে আদালত এবং আদালত সংশ্লিষ্টদের কোন সমস্যা না হয়; তারই আলোকে আদালত এ নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকীর আদালত এ আদেশ দেন বলে জানান, আদালতটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নূরী।
আদালতের আদেশের নথির বরাতে শাহজাহান নূরী বলেন, বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্যগত সনদ প্রদানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ বিধি-বিধান অনুসরণ করছেন না। ইতিপূর্বে এ নিয়ে একাধিকবার নির্দেশনার পরও স্বাস্থ্যবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও গাফেলতি পরীলক্ষিত হচ্ছে। এতে আইনে ব্যত্যয় ঘটার পাশাপাশি ন্যায়-বিচার ব্যাহত হচ্ছে। এমন কি আদালতকে অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হয়।
আদেশে বলা হয়েছে, ” হাসপাতাল থেকে প্রদত্ত ভিকটিমের জখমী সনদপত্রে সনদ প্রদানকারি বোর্ডের সদস্যদের স্বাক্ষরের নিচে নাম সহ সীল অনেক সময় ব্যবহার করেন না। যে কারণে জখমী সনদ ইস্যুকারি চিকিৎসককে চিহ্নিত বা সনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
তাছাড়া হাতে লিখে জখমী সনদ ইস্যু না করার জন্য বার বার নির্দেশনা দেওয়া সত্বেও তা যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সময় কম্পিউটারে টাইপকৃত জখমী সনদ ইস্যু করা হলেও ওই সনদগুলোতে নিন্মমানের কালি ব্যবহার করা হয়। এতে কিছুদিন পর মেডিকেল সনদগুলোর লেখা অস্পষ্ট হয়ে যায় অথবা আপনা-আপনি মুছে যায়। ”
এ ধরণের পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রদান করা সনদগুলোর তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বিড়ম্বনায় পড়ার পাশাপাশি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান চীফ জুতিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নূরী।
এ নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ” গত ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ক্রিমিনাল আপীল নং- ১০৯৬৯/২০১৯ এর একটি নির্দেশনা রয়েছে। এতে একই মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে হাতের লিখা সম্বলিত এবং কম্পিউটারে টাইপকৃত দু’টি পৃথক পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট সকল কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরন করা দরকার। প্রয়োজনে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ফরসেনিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ কর্তৃক উক্ত প্রতিবেদনগুলো প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ”
আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহজাহান নূরীর দেওয়া তথ্য মতে আদালতের দেওয়া ১২ টি নির্দেশনা হলঃ
(১) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর জারীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চাহিদাপত্র ব্যতীত জখমী সনদ ইস্যু না করা।
(২) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৯৫ সালের ১০ অক্টোবর ১৮০৬৯ নম্বর স্মারকে জারীকৃত পরিপত্রের নির্দেশনা মতে ৩ সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে জখমী সনদ ইস্যু করা। প্রয়োজন হলে আবাসিক মেডিকেল অফিসার, ইমার্জেন্সী মেডিকেল অফিসার এবং যে চিকিৎসক জখমীকে চিকিৎসা প্রদান করেছেন- তাঁদেরকে আই.ডি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), নাম, পদবী উল্লেখপূর্বক আবশ্যিকভাবে মেডিকেল বোর্ডে অর্ন্তভূক্ত রাখা।
(৩) ঈৎরসরহধষ জঁষবং ধহফ ঙৎফবৎং, ঠড়ষ-ওও এর ঋড়ৎস ঘড়. (গ)৪ অনুযায়ী জখমীর মেডিকেল সনদ ইস্যু করা।
(৪) সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জখমী সনদপত্রে জখমী সনদ প্রদানকারী মেডিকেল বোর্ডের সদস্যগণের স্বাক্ষরের নিচে আই.ডি নং (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), নাম ও পদবীসহ সীল, তারিখ ব্যবহার করা এবং মোবাইল ফোন নম্বর উল্লেখ করা।
(৫) হাতের লিখা জখমী সনদ সরবরাহ না করে, কম্পিউটারে টাইপকৃত জখমী সনদ সরবরাহ করা।
(৬) কম্পিউটার টাইপ করে ইস্যুকৃত জখমী সনদের লেখা মুছে যাওয়া কিংবা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকায় কম্পিউটারে টাইপকৃত জখমী সনদসমূহে উন্নতমানের প্রিন্টার ও কালি ব্যবহার করা।
(৭) একই ঘটনায়, একই ভিকটিমের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতালের জখমী সনদে আঘাতের বর্ণনার ভিন্নতা থাকার বিষয়ে এবং আঘাতের বর্ণনায় বানান ভুল না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।
(৮) জখমী সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে জখমী সনদে ভিকটিম ও ভিকটিমকে সনাক্তকারীর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তাদের স্বাক্ষর ও ঠিকানা নিশ্চিত করা।
(৯) সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রার পর্যালোচনা করে জখমী সনদ প্রদানের সুযোগ থাকলেও অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত ও আঘাত অনুযায়ী জখমী সনদ প্রদানের স্বার্থে জখমী সনদ ইস্যুকারী বোর্ডের সামনে ভিকটিমের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। জরুরী বিভাগের প্রাথমিক চিকিৎসা পরবর্তী জখমীকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হলে, সেক্ষেত্রে উক্ত ওয়ার্ডে অবস্থান করা রোগীর রেজিষ্টার পর্যালোচনা করে জরুরী বিভাগের রেজিষ্টার ও ওয়ার্ডে থাকা রেজিষ্ট্রারের তথ্যাবলী সমন্বয় করে পরিপূর্ণ জখমী সনদ সরবরাহ করা।
(১০) জখমী সনদ ইস্যুকালে সংশ্লিষ্ট এক্স-রে রিপোর্ট, সিটি স্ক্যান রিপোর্ট, আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট, ডিসচার্জ সার্টিফিকেট (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), অন্যান্য ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট ও আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র জখমী সনদের সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া। তাছাড়া উক্ত জখমী সনদের সাথে জখম সংক্রান্ত রেজিষ্ট্রারের সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠার সত্যায়িত ছায়াকপি সংযুক্ত করা।
(১১) ধর্ষণ সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে ধর্ষিতা ভিকটিমকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার (ফরেনসিক বিভাগ) দ্বারা পরীক্ষা করা, প্রয়োজনে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্তৃক উক্ত রিপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা করা। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাথে উক্ত বিষয়ে সমন্বয় সাধন করা।
(১২) পোস্ট মর্টেম প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বাক্ষরের নীচে সীলসহ স্পষ্ট নাম, পদবী, মোবাইল নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করা।
নির্দেশনায় আদালতের বিচারিক হাকিম আরো উল্লেখ করে বলেছেন, “স্বাস্থ্যগত সকল সনদ প্রতিটি মামলার বিচারকার্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক সনদ তৈরি ও সরবরাহে বিধি বিধান অনুসরণ করে সুস্পষ্ট লেখায় সরবরাহ করা হলে আদালত তা আমলে নিয়ে জখমের ধরন, জখমের মাত্রা দেখে অপরাধের পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করে আদালত বিচারকার্যে যথার্থ সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারে।
অপরদিকে, স্বাস্থ্যগত সনদ তৈরি ও সরবরাহে বিধি বিধান প্রতিপালন করা না হলে অপরাধের মাত্রা নিরূপণে সংকট সৃষ্টি হয়। বিচার প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয়। এতে বিচারপ্রার্থীদের কাছে বিচার বিভাগ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যায়। তাতে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হ্রাস পাওয়ার আশংকা থাকে। ”
আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নূরী জানিয়েছেন, উল্লেখিত ১২ দফা নির্দেশনা অনুসরণ করার জন্য কক্সবাজার সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার, কক্সবাজারের সিভিল সার্জন, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, পিবিআই/সিআইডি/ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজারের পুলিশ সুপার, কক্সবাজারের অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজারের সকল সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজারের সকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, কক্সবাজারের সকল আবাসিক মেডিকেল অফিসার এবং কক্সবাজারের সকল থানার অফিসার ইনচার্জের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-