বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যাকাণ্ড, ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় আরসা?

বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়ায় একটি শরনার্থী শিবিরে দু’জন রোহিঙ্গা নেতাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার পর সেখানে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে এপর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশ মনে করছে, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ শিবিরের নিয়ন্ত্রণ নিতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে।

এদিকে, রোহিঙ্গা নেতারা এসব ঘটনার জন্য জঙ্গী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাকে দায়ী করছেন।
কক্সবাজারে টেকনাফ এবং উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিচালনায় সহায়তার জন্য প্রতিটি শিবিরে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নির্বাচন করা হয়। যাদেরকে বলা হয় মাঝি।

কক্সবাজারের উখিয়ায় বালুখালি এলাকায় একটি শিবিরের এমন দুজন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যার ঘটনা ঘটে গত শনিবার সন্ধ্যায়।

ঐ শিবির থেকে একজন রোহিঙ্গা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, শিবির এলাকায় একটি দোকানের সামনে পনেরো বিশ জনের একটি দল ধারলো অস্ত্র নিয়ে ঐ দু’জন রোহিঙ্গা নেতা বা মাঝির ওপর হামলা করে এবং সেখানেই তাদের দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করে।

রোহিঙ্গা অনেক নেতা ধারণা করছেন, এই দু’জনকে টার্গেট করেই হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে পুলিশ বালুখালী এলাকার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

‘শিবিরে প্রভাব বিস্তারের জন্য রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা’
উখিয়া থেকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন বা এপিবিএন এর সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ মনে করেন এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য থেকে।

তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে দুস্কৃতকারীরা।”

“তারা (দুস্কৃতকারীরা) তাদের প্রভাব এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য এগুলো করছে যাতে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং অপহরণের মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারে। এটাই তাদের মূল লক্ষ্য।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আক্রমণ, হত্যাকাণ্ড বা সন্ত্রাসী তৎপরতার খবর সংবাদপত্রে শিরোনাম হচ্ছে অনেকদিন ধরেই।

রোহিঙ্গা নেতাদের হিসাবে, গত এক বছরে কমপক্ষে ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

আক্রমণকারীরা টার্গেট করছে বিভিন্ন শিবিরের রোহিঙ্গা মাঝি বা নেতাদের।

সেজন্য রোহিঙ্গা নেতাদের অনেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শিবিরের বাইরে নিরাপদ জায়গায় বাসা ভাড়া করে থাকছেন।

এমনই একজন মোহাম্মদ আমিন। তিনি একটি শিবিরের হেড মাঝি বা প্রধান নেতার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

মোহাম্মদ আমিন জানিয়েছেন, কয়েক মাস আগে তার ওপরও আক্রমণ হয়েছিল।

সে দফায় তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়ে শিবির ছেড়ে শিবিরের বাইরে একটি ভাড়া করা বাসায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করছেন। “নিরাপত্তার অভাবে আমি এখন শিবিরের বাইরে থাকি।”

মোহাম্মদ আমিন অভিযোগ করেন, শিবিরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে “আরসা একের পর এক হত্যাকাণ্ডসহ নানা রকম সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে।”

“এরা (আরসা) আমাদের নির্যাতন করে। এরা আমাদের দু’জন মাঝিকে (রোহিঙ্গা নেতা) হত্যা করেছে,” বলেন মোহাম্মদ আমিন।

আরসা’র তৎপরতার বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, “ক্যাম্পে যতক্ষণ প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলার লোকজন থাকে, ততক্ষণ তারা (আরসা) লুকিয়ে থাকে। ”

“প্রশাসন যখন ক্যাম্প থেকে চলে যায় তখন এরা (আরসা) ব্লকে ব্লকে আসে এবং আমাদের খোঁজ করে, গুলি করে, মারধোর করে” অভিযোগ মোহাম্মদ আমিনের।

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনা ঘটে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে।

শিবিরের পরিবেশ অস্থির
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার শিউলী শর্মা।

তিনি শিবিরগুলোতে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, শিবিরগুলোতে অস্থিরতা বাড়ছে এবং নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে।

শিউলী শর্মা বলেন, দিনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী এবং এনজিওদের তৎপরতা থাকে।

কিন্তু দিন শেষে অন্ধকার নামলেই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর তৎপরতা শুরু হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “দিনে পরিস্থিতি শান্ত হলেও সন্ধ্যার পর থেকে অন্য রকম একটা পরিবেশ তৈরি হয়। ওখানে (রোহিঙ্গা শিবিরে) উগ্রবাদী কিছু লোক সক্রিয়।”

যদিও পুলিশ বলেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর টার্গেট মূলত প্রভাব বিস্তার করে অবৈধ মাদক ব্যবসা করা।

কিন্তু মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন পরিস্থিতিটাকে দেখেন ভিন্নভাবে। তিনি রোহিঙ্গা শিবিরে তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসার মাধ্যমে মিয়ানমারে ফেরত যেতে চায়, কিন্তু আরসা এগুতে চায় সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।

এ দ্বন্দ্ব থেকেই এক বছর আগে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতাদের নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে মনে করেন নূর খান লিটন।

“রোহিঙ্গাদের সাধারণ জনগোষ্ঠী আসলে চায় যত দ্রুত সম্ভব একটা শান্তিপূর্ণ পন্থায় তারা যেন মিয়ানমারে ফেরত যেতে পারে।

“যখনই এই সাধারণ রোহিঙ্গারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরোধীতা করতে চায় বা নিজেরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে, তখনই আরসা আক্রমণ করে। এছাড়া অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোও সাধারণ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে,” বলেন নূর খান লিটন।

পুলিশ কর্মকার্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি তারা করছেন।

এছাড়া, তারা দাবি করেন, সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সহ বিভিন্ন বাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখাসহ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

সিবিজে/বিবিসি বাংলা/এএএ

আরও খবর