ইব্রাহিম খলিল মামুন, সমকাল :
কক্সবাজার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা পরিচয়ে ২০১৭ সালের ৭ জুন জেলা পাসপোর্ট কার্যালয়ে গিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন জয়নাব আক্তার নামে এক নারী। বাবা হিসেবে আমান উল্লাহ সিকদার ও মা আজু মেহের পরিচয় দেন তিনি। সঙ্গে জমা দেন সংশ্নিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর স্বাক্ষরিত জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র।
দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে, জয়নাব আক্তারের জন্মসনদ, জাতীয় সনদ ও প্রত্যয়নপত্রের ফটোকপি সত্যায়িত এবং তাঁকে তিন বছর ধরে পরিচিত বলে সত্যায়িত করেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়রা বেগম। এ ছাড়া ওই নারীর সনদপত্রের ক্রমিক নম্বর ১৯৯৬২ মুড়ি বইয়ে কাউন্সিলর মিজানুর রহমান নিজেকে মেয়র উল্লেখ করে জয়নাব আক্তারের কাগজপত্রে সিল ও স্বাক্ষর দেন। অথচ মিজানুর রহমান কখনও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ছিলেন না। অন্যদিকে যে তারিখে কাউন্সিলর জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন দেন; কাউন্সিলর কার্যালয়ের মুড়ি বইয়ে ওই তালিকায় জয়নাব আক্তার নামের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি।
নিজের সিল ও স্বাক্ষর স্বীকার করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন কাউন্সিলর মিজানুর রহমান।
একইভাবে কক্সবাজার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রাশেদা বেগম নামে আরেক রোহিঙ্গা নারীকে জাতীয় সনদপত্র দিয়েছেন ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আশরাফুল হক সিদ্দিকী জামসেদ। রাশেদা বেগমের পাসপোর্ট আবেদন ফরম এবং প্রত্যয়নপত্র সত্যায়িত করেছেন ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সালাউদ্দিন সেতু। অথচ পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে- রাশেদা বেগম বাংলাদেশি নাগরিক নন।
এভাবে কক্সবাজার ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন কক্সবাজার পৌরসভার কয়েক জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) কিছু অসাধু কর্মকর্তা। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাঁরা রোহিঙ্গাদের দিয়ে দিচ্ছেন ভুয়া নাম-ঠিকানার জন্মনিবন্ধন। এসব পাসপোর্ট ও সনদ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত স্থানীয় কাউন্সিলর, পুলিশ, আইনজীবীসহ সবাই। আর এসব কাগজ দিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে অনায়াসে মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি ইউরোপে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। এর ফলে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী হওয়ায় তাদের কারণে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। ২০১৭ থেকে ‘২০ সালের শতাধিক পাসপোর্ট পুনর্তদন্ত করে এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে দুদক।
সেই তদন্তের অংশ হিসেবে কক্সবাজার পৌরসভার বর্তমান ও সাবেক ৭ কাউন্সিলর এবং কক্সবাজার সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে তলব করেছে দুদক।
যাঁদেরকে তলব করা হয়েছে তাঁরা হলেন- কক্সবাজার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান; ১, ২ ও ৩ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জেলা মহিলা দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হুমায়রা বেগম, ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামশেদ, ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সালাউদ্দিন সেতু, সাবেক কাউন্সিলর জাবেদ মোহাম্মদ কায়সার নোবেল, কক্সবাজার পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র, জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম; ১০, ১১ ও ১২ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জেলা মহিলা দলের সভাপতি নাসিমা আক্তার বকুল এবং কক্সবাজার সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক আহমদ।
গত ৫ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে কক্সবাজার পৌর কাউন্সিলরদের একটি নোটিশ দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক। নোটিশ পাওয়ার কথা স্বীকার করে কক্সবাজার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘যথাসময়ে দুদক কার্যালয়ে গিয়ে আমি বক্তব্য প্রদান করব।’
নোটিশের কথা স্বীকার করে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র, জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তথ্য যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব মূলত স্থানীয় কাউন্সিলরের। আমি যে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছি ওটা ২ নম্বর ওয়ার্ডের। সেখানে স্থানীয় কাউন্সিলর মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর দেখেই প্যানেল মেয়র হিসেবে আমি স্বাক্ষর করেছি।’
এর আগে ২০২১ সালের ২৫ মার্চ এসব ঘটনায় চট্টগ্রামের দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে ১১টি মামলা হয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা বাদী হয়ে মামলাগুলো করেন। এতে কক্সবাজার সদর পৌরসভার সাবেক ও বর্তমান সাত কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের দুই চেয়ারম্যান, ডিএসবির তিন পরিদর্শক, দুই সহকারী উপপরিদর্শক, জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন আইনজীবীসহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা সদস্যকে আসামি করা হয়।
মামলার আসামি পুলিশ সদস্যরা হলেন- ডিএসবির সাবেক পরিদর্শক মিজানুর রহমান (বর্তমানে চট্টগ্রাম সিআইডি), সাবেক পরিদর্শক কাজী মো. দিদারুল আলম (বর্তমানে কোর্ট পরিদর্শক ব্রাহ্মণবাড়িয়া), সাবেক পরিদর্শক প্রভাষ চন্দ্র ধর (বর্তমানে ডিআইজি অফিস রংপুর), বিশেষ শাখার এএসআই জাহিদুল ইসলাম (বর্তমানে রাঙামাটি পুলিশ লাইন্স) এবং সাবেক এএসআই সাজেদুর রহমান (বর্তমানে ফেনীর ডিবিতে কর্মরত)।
এ ছাড়াও চেয়ারম্যানদের মধ্যে মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন খোকন ও সচিব প্রিয়তোষ দে এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অ্যাডভোকেট (নোটারি পাবলিক) আবুল কালাম আজাদকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার পরপরই ২০২১ সালের ২৮ মার্চ কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর জাবেদ মো. কায়সার নোবেল, রফিকুল ইসলাম এবং বর্তমান কাউন্সিলর মিজানুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে দুদক। পরে তাঁরা সবাই জামিনে বেরিয়ে আসেন।
তদন্তসংশ্নিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারকেন্দ্রিক মানব পাচারকারী একটি চক্র রোহিঙ্গাদের বিদেশে পাঠানোর নামে তাদের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা নেয়। প্রথমে তারা কাউন্সিলর-চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে। এর পর ভুয়া নাম-ঠিকানায় না গিয়েই ভেরিফিকেশন রিপোর্ট দেয় পুলিশ। তার জন্য দেওয়া হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এভাবে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট হয়ে যায় টাকা দিলেই।
এ বিষয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও পাঁচ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘একজন বাংলাদেশি নাগরিক পাসপোর্টের আবেদন করতে গেলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁদের সত্যায়ন প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন হয় পুলিশের ভেরিফিকেশন। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে জাল-জালিয়াতির কাগজপত্র প্রদর্শনসহ পুলিশ সদস্যরা ভেরিফিকেশন না করেই আবেদনকারীর সব তথ্য সঠিক বলে নোট দেন। এতে বাংলাদেশি নাগরিক না হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা এ দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-