মিয়ানমার থেকে প্রাণ রক্ষার্থে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা এবং বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ প্রায় চার দশকের পুরনো ঘটনা। সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে আগমন ঘটলেও তাদের মূল স্রোতটি আসে ২০১৭-এর ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত গণহত্যার অব্যবহিত পরে। আগে থেকে অবস্থানরত প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। সর্বশেষ স্রোত তথা ২০১৭-এর গণহত্যার পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলেও এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও তাদের পরিস্থিতির যেমন কোনো উন্নতি ঘটেনি, তেমনি তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার আশাব্যঞ্জক সম্ভাবনাও পরিলক্ষিত হয়নি। অবস্থা তথৈবচ। তথাপি বর্তমান পরিস্থিতির সাধারণ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কক্সবাজারে তাদের থাকার জন্য নব্বাইয়ের দশকের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সহায়তায় দুটি নিবন্ধিত শরণার্থী শিবির স্থাপন করা হয়েছে: একটি উখিয়ায় এবং অন্যটি টেকনাফে। ২০১৭-এর গণহত্যাসূচক নির্যাতনের পর তাদের মূলস্রোতটি আসতে শুরু করে। নতুন করে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গার থাকার জন্য তাই আরো ৩২টি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ৩৪টি ক্যাম্পে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ফলে তাদের থাকা-খাওয়ার সংস্থান হলেও, জীবন রক্ষা পেলেও ক্যাম্পগুলোয় তারা যেভাবে বসবাস করতে বাধ্য হয়, তা চূড়ান্ত বিচারে অমানবিক।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প পৃথিবীর সবচেয়ে জনাকীর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বাস। পরিবারের পাঁচজন বা তার বেশি সদস্য মাত্র ১০-১৬ ফুটের একটি কক্ষে বাস করে। আশ্রয়কেন্দ্র বা কুটিরগুলো নীল তেরপল এবং বাঁশ দিয়ে তৈরি, যা আশ্রয়কেন্দ্রকে অসহনীয় তপ্ত করে রাখে।
ক্যাম্পে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং আরো কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা খাদ্য সরবরাহ করে আসছে। দুই বছর আগেও তাদের জন্য সরবরাহকৃত খাদ্য তালিকায় খাদ্যের ধরন নির্দিষ্ট ছিল, কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা তাদের ফুড কার্ড দেখিয়ে নির্দিষ্ট দোকান থেকে তাদের পছন্দের খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করার সুযোগ পাচ্ছে। যদিও তারা প্রতি মাসেই খাদ্যসহায়তা পেয়ে আসছে, তারা যা পায় তা তাদের চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত, যেখানে খাদ্যপণ্য সাধারণত একই ধরনের, বৈচিত্র্যহীন। তথাপি রোহিঙ্গাদের দিনের পর দিন খাদ্যসহায়তা অব্যাহত রাখার দরুন স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
পর্যাপ্ত না হলেও, খাদ্যসহায়তার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রধান খাদ্যচাহিদা পূরণ করা হয়। তবে তা একদিকে তাদের কাজ করার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করছে, এবং অন্যদিকে এটি স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। অব্যাহত খাদ্যসহায়তা নিয়ে রোহিঙ্গারা যে খুব খুশি, তাও কিন্তু নয়। কারণ তারা সব ধরনের খাদ্যপণ্য পাচ্ছে না, আবার ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে খাদ্যপণ্য কিনতেও পারছে না; এবং এ কারণে তাদের কাজ করার সুযোগ দেয়া হয় না। তথাপি তারা কাজ করে তাদের জীবিকা অর্জন করতে চায়, তারা খাদ্য- বস্ত্রসহ তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো নিজেরাই মেটানোর সক্ষমতা (চলাচলের স্বাধীনতা, কাজ করার অনুমতি, ইত্যাদি) চায়।
শুধু বাসস্থান বা খাদ্য সংস্থানই নয়, ক্যাম্পগুলোয় রোহিঙ্গাদের বসবাসে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা যেমন—জামা-কাপড়, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পো, স্যান্ডেল, মশারি, স্যানিটারি প্যাড ইত্যাদি প্রদান করা হয়। তার পরও রোহিঙ্গাদের সহায়তা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর নয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে সহায়তা সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয়হীনতার কারণে রোহিঙ্গাদের এমন এমন জিনিস সরবরাহ করা হয় যেগুলো ব্যবহার করতে তারা অভ্যস্ত নয়, যেমন শ্যাম্পো ও ডিশ ক্লিনার। তাছাড়া তাদের কোনো কোনো সামগ্রী প্রয়োজনের অতিরিক্ত সরবরাহ করা হয়। তারা বিভিন্ন সংস্থা থেকে একই ধরনের পণ্য পাচ্ছে। এ অবস্থায় তারা স্থানীয় বাজার বা ব্যক্তির কাছে অতিরিক্ত পণ্য কম মূল্যে বিক্রি করে দেয়; ফলে স্থানীয় বাজারে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা স্থানীয়দের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য প্রতিটি ক্যাম্পে বেশকিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও তারা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবায় সন্তুষ্ট নয়। তাদের অ্যাকসেস যেমনি কঠিন, তেমনি স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা ভালো ব্যবহার থেকেও তারা বঞ্চিত। ফলে তারা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পায় না। ২০১৭-এর গণহত্যার শিকারদের মানসিক ট্রমার জন্য মানসিক চিকিৎসা বা সহায়তা অত্যন্ত অপ্রতুল ও অনিয়মিত। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে, যেখানে প্রয়োজনীয় পরিষেবা যেমন স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা বা টিকার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। সীমিত পরিসরে অনেক মানুষের বসবাসের কারণে তাদের অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে।
শুরু থেকেই ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা চলাফেরার স্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং তাদের জীবন মূলত ক্যাম্পের সীমানায় সীমাবদ্ধ, যে কারণে তাদের অনেকেই তাদের ক্যাম্প জীবনকে খোলা-আকাশের নিচে বিশেষ ‘কারাগার’ বলে অভিহিত করেন। তাছাড়া এখানে রোহিঙ্গাদের কাজ করার কোনো অধিকার নেই। তবে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে অনানুষ্ঠানিকভাবে অবৈধ পন্থায় নানা কাজের সঙ্গে জড়িত। এ অবস্থায় স্থানীয়রা তাদের কম মজুরিতে নিয়োগ দেয়; এবং এর ফলে স্থানীয় শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়, যা প্রকারান্তরে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে করে রোহিঙ্গাদের ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী করা যায়। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা যেন বর্তমান অবস্থায় অব্যাহত রাখতে না হয়। তবে বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় সমাজে রোহিঙ্গাদের মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা বা আশঙ্কায় এখনো তাদের স্বাধীন চলাচল বা কাজের প্রবেশাধিকার সম্মত নয়।
যদিও ক্যাম্পের মধ্যে কিছু অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোয় প্রধানত ইংরেজি, গণিত এবং বার্মিজ ভাষার কিছু প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে । তবে কিছুদিন পর একঘেয়ে পাঠদানের কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ই এ শিক্ষা থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ১৪ বছরের কম বয়সী রোহিঙ্গাদের (প্রায় অর্ধেক রোহিঙ্গা জনসংখ্যা) স্বীকৃত/আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ইত্যাদির অভাবে মূলত নিষ্ক্রিয় ও অলস জীবনযাপন করছে, যারা শিগগিরই হারানো প্রজন্মের (লস্ট জেনারেশন) অতল গহব্বরে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থা রোহিঙ্গাদের জন্য যেমনি ক্ষতিকর, তেমনি স্থানীয় জনজীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা যে পরিবেশে বসবাস করছে তাকে এক কথায় বলা যায়, জীবন রক্ষার্থে জীবনযাপনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধাবিহীন অবস্থায় তারা ক্যাম্পের মধ্যে অন্তরীণ ও মানবেতর অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। নিরাপদে বসবাস এখন চ্যালেঞ্জের মধ্যে নিপতিত। যদিও প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য, বিদ্যমান অনিরাপত্তা ও বৈরী অবস্থা নারী, শিশু এবং বয়স্কদের জন্য চরম বাস্তবতা। অন্তরীণ ক্যাম্পে সব বয়সের নারীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় বাস করছে যেখানে গার্হস্থ্য নির্যাতন ও যৌন সহিংসতা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা, খেলাধুলা, প্রশিক্ষণ, বিনোদন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা বর্তমানে অসুখী ও অলস, এবং যাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন। ক্রমে ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা বেড়েছে (চুরি, ছিনতাই, ছিনতাই, সংঘাত), হত্যাকাণ্ডও বেড়েছে। ক্যাম্পের মধ্যে মারামারি, নারী নির্যাতন, বহুবিবাহ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ায় এবং রোহিঙ্গাদের অস্থিতিশীল অবস্থায় বসবাসের ফলে নিরাপত্তা বাহিনীকে সবসময় তত্পর থাকতে হচ্ছে। ক্যাম্পে নিরাপত্তা বাহিনীর আসা-যাওয়া ও তদারকি এতটাই বেড়ে গেছে যে ক্যাম্প সত্যিই যেন কারাগারে পরিণত হয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব স্থানীয় সমাজেও পরিলক্ষিত।
মানবাধিকার সংস্থার সহায়তা ব্যতীত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও সার্বিক সহায়তা প্রদান সম্ভব হতো না। তবে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম ও চেষ্টা অনেকটা ব্যর্থ বা অপর্যাপ্ত বলা যায়। তাদের কার্যক্রম মূলত ক্যাম্পকেন্দ্রিক, কীভাবে রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নত করা যায়। অর্থাৎ তাদের মূল ফোকাস রোহিঙ্গাদের স্বাবলম্বী করার দিকে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন বা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দিকে নয়। তাছাড়া মানবাধিকার সংস্থাগুলো যেভাবে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করছে তাতে রোহিঙ্গাদের কার্যত কোনো উপকার হচ্ছে না, অথচ স্থানীয়রা ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা করা হচ্ছে না; যেখানে তাদের কোনোরূপ অংশগ্রহণও নেই। কারণ রোহিঙ্গাদের কাছে তাদের কাজের দায়বদ্ধতা নেই, তারা মূলত দাতা সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের বাস্তব অবস্থা বোঝার জন্য, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর রোহিঙ্গাদের চাপ, বোঝা এবং সে অনুযায়ী স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য একটি সমগ্র সমাজ দৃষ্টিভঙ্গি (হোল-অব-সোসাইটি এপ্রোচ) প্রয়োজন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উপস্থিতিতে চোখের সামনে, সবার জ্ঞাতসারে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন হতে দেয়া যায় না। আর স্থানীয় জনগণের ওপর রোহিঙ্গাদের ভার যদি দীর্ঘায়িত হয়, তা প্রকারান্তরে অদূর ভবিষ্যতে অমানবিক পরিণতি বয়ে আনবে।
যদিও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসার পর থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ক্রমাগত আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রয়েছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে দুবার প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল (২০১৮-১৯ সালে), ফল একদম শূন্য। অবস্থা এমন, অদূর ভবিষ্যতে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। তবে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে (আরাকান/রাখাইন) ফেরার জন্য ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছে। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের ওপর কার্যকর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ভূখণ্ডে তাদের প্রত্যাবাসনে কোনো অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। তথাপি রোহিঙ্গাদের মাঝে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে উদ্যোগ লক্ষ করা গেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন উদ্যোগের প্রধানতম নেতা মহিবুল্লাহ মাস্টার হত্যার পর (সেপ্টেম্বর ২০২১), রাখাইনে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে যায়। তবে তারা আবারো ‘বাড়ি চল’ নামে প্রত্যাবাসনে প্রচারণা শুরু করেছে। জুন ২০২২-এ তারা ক্যাম্পের মধ্যে এ বিষয়ে কয়েকটি সমাবেশও করেছে। কারণ বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে তারা বাংলাদেশ অচলাবস্থায় দিনের পর দিন আটকে থাকতে চায় না; কিন্তু দেশে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগও তারা পাচ্ছে না। তাদের প্রত্যাবাসন এখানেই আটকে আছে।
রাখাইনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে না পেরে বাংলাদেশ সরকার অবশেষে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ কমাতে এবং বিবদমান পরিস্থিতি কিছুটা প্রশমিত করতে উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্প থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের কাছে সদ্য জেগে ওঠা ভাসানচর দ্বীপে এক লাখ রোহিঙ্গার আবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া এ প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর সম্ভব হয়েছে। ভাসানচর প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা বা সম্ভাবনা, নিরাপত্তার সমস্যা, পুনর্বাসনের দুর্ভোগ ইত্যাদি সমস্যার কথা বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ পুনর্বাসনের বিরোধিতা করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন মেনে নিয়ে রোহিঙ্গাদের সহায়তা কর্মসূচি শুরু করেছে। এ পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, এবং যত সংখ্যক রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে তা খরচ ও ব্যবস্থাপনার তুলনায় নগণ্য। তাছাড়া পুনর্বাসিত হওয়ার কিছুদিন পরপর ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়, যা প্রকারান্তরে ভাসানচরের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার পরিচায়ক।
উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অবস্থান পাঁচ বছরের পুরনো, যাদের সংখ্যা স্থানীয়দের প্রায় দ্বিগুণ। প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় জনগণ উভয়ের মধ্যে সংহতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও ধীরে ধীরে তা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। এখন রোহিঙ্গারা মনে করে, তারা ক্যাম্পে আর নিরাপদ নয়, তারা আর আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। কারণ স্থানীয়রা তাদের সঙ্গে নানাভাবে অন্যায় করছে, খারাপ আচরণ করছে। স্থানীয়রা বর্তমানে রোহিঙ্গা প্রশ্নে সহনশক্তিহীন হয়ে উঠেছে। তারা মনে করেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের পর থেকে স্থানীয় সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, পরিবেশ, যাতায়াত সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই স্থানীয়রা আর রোহিঙ্গাদের সহ্য করতে পারছে না। তারা চায় যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গারা তাদের গৃহে ফিরে যাক। তারা মনে করছে, রোহিঙ্গারা বেশি দিন থাকলে স্থানীয় সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। রোহিঙ্গারাও তাই চায়। কারণ রাষ্ট্র ও নাগরিকত্ববিহীন অবস্থায়, শিক্ষা, অবাধ চলাফেরা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ছাড়া কোনো জাতি দেশের বাইরে বেশি দিন অনিশ্চিত আবদ্ধ অবস্থায় থাকতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারও চায় রোহিঙ্গারা তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাক। কিন্তু সরকার বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের প্রত্যাবাসনে অনিবার্য শর্ত তথা রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে অনেকাংশে ব্যর্থ। এ অবস্থায় মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থান এবং চলমান সামরিক শাসনের কারণে বর্তমানে কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারময়।
ড. আলা উদ্দিন: অধ্যাপক
নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-