মুনাফিক চেনার উপায়?

মুনাফিক’ শব্দটি ‘নফক’ শব্দ থেকে গঠিত। নফকের অর্থ- গর্ত, ছিদ্র, সুড়ঙ্গ, বের হওয়া, খরচ করা, ব্যয় করা। কারো মতে, ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ (পাহাড়ি ইঁদুর) থেকে মুনাফিক শব্দটি গঠিত। পাহাড়ি ইঁদুরকে ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ বলা হয়। কারণ পাহাড়ি ইঁদুর অত্যন্ত ধূর্ত ও চতুর হয়, এরা পাহাড়ে অনেক গর্ত খনন করে। এদের মারার জন্য এক গর্তে পানি বা অন্য কিছু দিলে অন্য গর্ত দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যায়, ফলে এদের সহজে মারা যায় না। মুনাফিকও অনুরূপ ধূর্ত। তাদেরকে সহজে চেনা যায় না। মুনাফিকের সংজ্ঞায় সাইয়েদ মুফতি আমিনুল ইহসান বলেছেন, মুনাফিক হলো এমন ব্যক্তি যে ইসলামকে মুখে প্রকাশ করে এবং অন্তরে কুফরিকে লালন করে।
মুনাফিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলি: আল্লাহ সূরা বাকারায় ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। তা ছাড়া বিভিন্ন সূরায় আরো ৩৮টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা করেছেন। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলি হলো-
তারা সন্দেহপ্রবণ, দ্বিধাগ্রস্ত ও সুবিধাবাদী: মুনাফিকরা সুবিধা ভোগের জন্য ইসলামে দাখিল হয়; কিন্তু ইসলামের বিধিবিধান পালন ও ইসলামের আনুগত্যের কষ্ট স্বীকার করতে রাজি নয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

‘(তাদের উদাহরণ হলো) বর্ষণমুখর ঘন মেঘের মতো, যাতে রয়েছে ঘোর অন্ধকার, বজ্রের গর্জন ও বিদ্যুতের চমক; বজ্রধ্বনিতে মৃত্যুভয়ে তারা তাদের কানে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়; আল্লাহ এসব সত্য প্রত্যাখ্যানকারী লোকদের সর্বদিক দিয়ে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। অর্থাৎ তারা আল্লাহর আয়ত্তের ভেতরে আছে, তিনি তাদের সম্পর্কে জানেন’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৯)।

মুনাফিকের হৃদয় অসুস্থ: মুনাফিকদের আকিদা-বিশ্বাসে সন্দেহ, অস্বীকৃতি ও মিথ্যা থাকার কারণে তাদের কলবকে অসুস্থ কলব বলা হয়। দ্বিমুখী আচরণ একটি কঠিন ব্যাধি। আর খাঁটি বিশ্বাস হলো সুস্থতা। ঈমান আনার পর যারা দ্বিমুখী আচরণ করে, তারা মূলত অসুস্থ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

‘তাদের হৃদয়ে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ সে ব্যাধিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের মিথ্যাচারের দরুন তাদের জন্য রয়েছে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (সূরা বাকারা : ১০)।

দু’মুখো স্বভাব: বাহ্যিকভাবে নিজেদের মুমিন বলে পরিচয় দেয় অথচ তাদের ভেতরে ঈমান নেই। ঈমান তিনটি জিনিসের সমন্বয়ের নাম- ১. অন্তরের বিশ্বাস; ২. মৌখিক স্বীকৃতি এবং ৩. স্বীকৃতি অনুযায়ী আমল করা (ইবনে মাজাহ)। মুনাফিক শুধু মৌখিকভাবে ঈমানের স্বীকৃতি দান করে, কিন্তু অন্তরে মোটেও বিশ্বাস করে না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

‘আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা বলে আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান এনেছি, অথচ তারা মুমিন নয়’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৮)।

নিজেদের শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী মনে করে: মুনাফিকরা সমাজে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাসাদ ও অশান্তি সৃষ্টি করে থাকে, অথচ তারা প্রচার-প্রপাগান্ডায় নিজেদের শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী বলে পরিচয় দেয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

‘আর যখনই তাদের বলা হয়, পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা উত্তরে বলে- আমরাই তো সংশোধনকারী ও শান্তিকামী’ (সূরা বাকারা : ১১)।

মুমিনদের নির্বোধ মনে করে: মুনাফিকরা নিজেদের বুদ্ধিমান, ধূর্ত, চতুর ও চালাক মনে করে। আর মুমিন, মুত্তাকি ও নেককারদের নির্বোধ ও বোকা বলে মনে করে। অথচ আল্লাহ তায়ালার কাছে তারাই বোকা ও নির্বোধ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

‘যখন তাদের বলা হয়, অন্য লোকদের মতো তোমরাও ঈমান আনো, তখন তারা বলে, আমরা কি সেই নির্বোধ লোকদের মতো ঈমান আনব? আসলে তারাই তো নির্বোধ, কিন্তু তাদের সে জ্ঞান নেই’ (সূরা বাকারা : ১৩)।

বিভ্রান্তিতে ঘুরে বেড়ায়: মুনাফিকদের তাদের ভ্রষ্টতার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি না দেয়ায় এবং দুর্নীতিপরায়ণ হয়েও পার্থিব জগতে সুখ-শান্তিতে কালাতিপাত করার সুযোগদানের ফলে তাদের ভ্রষ্টতা আরো গভীরে অনুপ্রবেশ করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

‘বস্তুত আল্লাহই তাদের সাথে তামাশা করছেন (তাদের তামাশার জবাব দিচ্ছেন) এবং তাদের অবাধ্যতার বিভ্রান্তিতে ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ দিচ্ছেন’ (সূরা বাকারা : ১৬)।

রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যখন তোমরা কোনো বান্দাকে দেখতে পাও যে সে পাপি হওয়া সত্ত্বেও তার পছন্দনীয় জিনিস তাকে দেয়া হচ্ছে এবং সে সুখ-শান্তিতে আছে, তবে মনে করবে তা তার জন্য পাকড়াও করার অবকাশ মাত্র।’ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

‘আমি শাস্তি না দিয়ে সুযোগ দিই পাপ বৃদ্ধির জন্য’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৭৮)।

মুনাফিক নিজেকেই ধোঁকা দেয়: ‘আল্লাহ ও ঈমানদারদের তারা ধোঁকা দিতে চায়, আসলে তারা অন্য কাউকে ধোঁকা দিচ্ছে না, বরং নিজেদেরই প্রতারিত করছে, অথচ তাদের সে অনুভূতি নেই’ (সূরা বাকারা : ৯)।
ভ্রষ্টতা ক্রয় করে: মুনাফিকরা দুনিয়ার লালসায় হেদায়েতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতাকে গ্রহণ করে। তারা হেদায়েতের ওপর ভ্রষ্টতাকে অগ্রাধিকার দেয়। মানুষ যে জিনিসকে ভালোবাসে ও পছন্দ করে, সে জিনিসই ক্রয় করে। মুনাফিকরা ঈমান বিক্রি করে নিফাককে ক্রয় করে অর্থাৎ ঈমানের ওপর নিফাককে প্রাধান্য দেয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

‘তারা এমন লোক, যারা হেদায়েতের পরিবর্তে ভ্রষ্টতাকে ক্রয় করে নিয়েছে। সুতরাং তাদের এ ব্যবসায় লাভজনক হয়নি; আর তারা হেদায়েতও পায়নি’ (সূরা বাকারা : ১৬)।

সুসময়ের সঙ্গী: মুনাফিকরা মুসলমানদের সুখ-শান্তি দেখলে ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে। আর যখন মুসলমানরা দুখ-কষ্ট ও বিপদাপদে পতিত হয়, তখন নীরবে কেটে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘বিদ্যুৎ চমক যেন তাদের দৃষ্টিশক্তিকে ছিনিয়ে নেয়। যখনই তারা তাদের একটু আলো দেয়, তারা পথ চলে, আর যখনই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তখনই থমকে দাঁড়ায়।’ অর্থাৎ সুসময়ে ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে, আর যখন বিপদ দেখতে পায়, তখন সিটকে পড়ে এবং আগের নিফাকিতে অবিচল ও অটল থাকে।

মিথ্যাবাদী:

মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: সম্পর্কে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’। (সূরা মুনাফিকুন-১)

আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টিকারী:

মুনাফিকরা মানুষকে আল্লাহর দিকে আসতে দেয় না। তারা নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে। তারা যা করছে, তা খুবই মন্দ’ (সূরা মুনাফিকুন-২)।

অহঙ্কারী:

মুনাফিকরা অহঙ্কারী ও দাম্ভিক। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আপনি তাদের দেখবেন যে তারা অহঙ্কার করে মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (সূরা মুনাফিকুন, আয়াত-৬)।

প্রতারক:

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে প্রতারণা করছে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। বস্তুত তারা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন একান্ত শিথিলভাবে লোকদেখানোর জন্য দাঁড়ায়। তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে। এরা দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত; এদিকেও নয়, ওদিকেও নয়’ (সূরা নিসা, আয়াত : ১৪৩-১৪৪)।

পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরিফে মুনাফিকদের আরো অসংখ্য বৈশিষ্ট্য ও চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এসব অসৎ বৈশিষ্ট্যাবলি থেকে হিফাজত করুন, আমীন!

আরও খবর