রোহিঙ্গা আশ্রয়ের পাঁচ বছরেও প্রত্যাবাসন যেনো মহা দুঃস্বপ্ন!

ইমরান আল মাহমুদ,উখিয়া:
বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুটি জটিল রূপ নিচ্ছে ক্রমশ। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনার শুরুতে এটিই ছিল একটি আশার বিষয়। দিন যতই গড়িয়েছে, তাতে হতাশার জন্ম নিয়েছে। আর এখন এটি যেন পরিণত হয়েছে রীতিমতো মহা এক দুঃস্বপ্নে। মিয়ানমার পক্ষ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আগের অবস্থানেই আছে, যে অবস্থান থেকে তারা এক চুলও সরেনি। মিয়ানমার পক্ষ প্রত্যাবাসন ইস্যু থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছে। বাংলাদেশ সরকার পক্ষ প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বাস্তবায়নে জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বের দরবারে ক্রমাগতভাবে আবেদন করে আসছে গত পাঁচ বছর ধরে। এরই প্রেক্ষিতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ সফর করছেন জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিরা। এসময় রোহিঙ্গাদের নানা সমস্যার কথা শুনতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন তারা।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সর্বশেষ নির্যাতনের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গারা। পাঁচবছর পর তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত ১৩ লাখ। ক্রমশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে অস্থিরতা ও অপরাধ কর্মকাণ্ড।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন(এপিবিএন) এর তিনটি ব্যাটালিয়ন। ৮ এপিবিএন এর তথ্য অনুযায়ী গতবছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে এবছরের ২০ আগস্ট পর্যন্ত ১৫ টি অস্ত্র মামলায় ৩১ জন আসামি গ্রেফতার,৩শ ৯০টি মাদক মামলায় ৪শ ৯৯ জন, ৪টি অপহরণ মামলায় ১৭জন,১২টি বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় ২২জন,২০টি ডাকাতি প্রস্তুতি মামলায় ১শ ২৯ জন অন্যান্য মামলায় ২৮ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তৎমধ্যে তালিকাভুক্ত দুষ্কৃতকারী রয়েছে ৯২ জন,এজাহারনামীয় আসামি ১শ ২২জন,সন্দিগ্ধ আসামি ৮জন,রোহিঙ্গা দুষ্কৃতকারী ৬০ জন,মোবাইল কোর্টে দন্ডপ্রাপ্ত ৩৮জন।

সরেজমিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেখা যায়, পাঁচবছর আগে আশ্রয় নিলেও রোহিঙ্গাদের মাঝে আগের মতো শান্ত পরিবেশ অনেকটা লক্ষ্য করা যায়না। নিরাপত্তার বিষয়ে অনেক রোহিঙ্গা মুখ খুলতে নারাজ।

বালুখালী ক্যাম্প-৯ এর রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার শফিউল্লাহ বলেন,”আমরা শরণার্থী জীবন আর চায়না। আমাদের নিরাপত্তা, অধিকার নিশ্চিত করে নিজ দেশ মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর দাবি জানাচ্ছি জাতিসংঘ, বাংলাদেশ, আমেরিকা, ইসলামিক সংস্থাগুলোর কাছে। এখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে জাতির শিক্ষা নাই সে জাতির অস্তিত্বও নেই। তাই আমরা আমাদের অধিকার জাতিগত বৈষম্য বাদ দিয়ে সমান অধিকার ফিরে পেলে মিয়ানমার যেতে রাজি।”

তিনি আরও বলেন,”আমাদের দুঃসময়ে বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় দিয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার নারী -পুরুষ শিশু,যুবক যুবতী সহ প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে গণহত্যার মিশনে নেমে হত্যা করে। বাংলাদেশ যদি আশ্রয় না দিতো সব রোহিঙ্গাদের হত্যা করতো মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী। তবে পাঁচ বছর পূর্ণ হলেও অনিশ্চিত অবস্থায় দিনাতিপাত করছি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ক্যাম্পেও মাঝেমধ্যে দুষ্কৃতকারীরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অনেক কে হত্যা করেছে। পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে সাত দফা দাবি নিয়ে সমাবেশ করা হবে।”

বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা জানায়,ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দুষ্কৃতকারীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার জন্য কথা বলা রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে। যা মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যা থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় বলে জানান তারা। তবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার জন্য করে যাওয়া মুহিবুল্লাহর সংগঠনের মাধ্যমে সমস্ত সমাবেশ করা হয় বলেও জানায় রোহিঙ্গা নেতারা।

গত ১৬ আগস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রধান ও চিলি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাচেলেট। জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ এ কর্মকর্তার চারদিনের সফর ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সফরকালে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী,পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক করেন এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা,যুবক ও নারীদের সাথে মতবিনিময় করেন তিনি। এসময় রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য ধৈর্য্য ধরতে বলেন। পরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন সহ সব বৈঠক নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিশেল ব্যাচেলেট বলেন,”রোহিঙ্গাদের এখন মিয়ানমার ফেরত পাঠালে আবারও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসতে পারে। তাই নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করছে জাতিসংঘ।”

এরপর গত ২৩ আগস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক দূত নোলিন হাইজারের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল। এসময় তিনি রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন এবং প্রত্যবাসন বিষয়ে জাতিসংঘ কাজ করছে বলে রোহিঙ্গাদের সাথে মতবিনিময়কালে জানায়।

এদিকে,দিন যত গড়াচ্ছে ততই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গারা জড়াচ্ছে নানা অপরাধে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণে হুমকির মুখে রয়েছে স্থানীয়রা। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের নিকটস্থ রাজাপালং ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন,”দীর্ঘ ৫ বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া আমাদের জন্য খুবই হতাশাজনক। দীর্ঘদিন রোহিঙ্গা আমাদের এলাকায় অবস্থানের কারনে তারা নানা অপরাধে জড়িত হচ্ছে। আমরা স্থারীয়রা আতংকের মধ্যে রয়েছি। আমাদের একটাই দাবী দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হউক।”

ক্যাম্পে তিনবছর যাবত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আনোয়ার জানান,দুষ্কৃতিকারীদের আনাগোনা বিবেচনা করে ক্যাম্পের মাঝে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী চেকপোস্ট স্থাপন করে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে। ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার ও পুলিশি সেবা ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে গুরুত্ব বিবেচনায় অপরাধ প্রবণ রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় দিবারাত্রী ৭টি মোবাইল টহল ডিউটি এবং ৭টি হোন্ডা টহল ডিউটি পরিচালনা অব্যাহত আছে। তাছাড়া ক্যাম্পের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধীদের গ্রেফতার, অস্ত্র, মাদক ও চোরাচালান সামগ্রী উদ্ধারের লক্ষ্যে নিয়মিত বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে এবং ক্যাম্প এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে নিয়মিত ব্লক রেইড চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।

৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(মিডিয়া) মো. কামরান হোসেন বলেন,”রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ৮এপিবিএন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্ব গ্রহণের ১৮ মাসে ২২ লক্ষ পিস ইয়াবা উদ্ধারের সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাছাড়া দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রকাশ অস্ত্র উদ্ধার সহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ৮ এপিবিএন। রোহিঙ্গাদের মাঝে স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা সর্বপ্রথম ৮ এপিবিএন চালু করে। যার ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে বর্তমানে সব ক্যাম্পে চালু রয়েছে।”

এদিকে,রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়ের পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন ক্যাম্পে সমাবেশ করার জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে রোহিঙ্গারা। ব্যানার, ফেস্টুন সহ বিভিন্ন প্লে কার্ড হাতে তারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার দাবি জানাবেন বলে জানা যায়।