কক্সবাজারে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি

বিশেষ প্রতিবেদক •

সাধারণ মানুষের জীবনে ডিম-ভাত, ডিম সেদ্ধ, ওমলেট, পোচ নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যের মধ্যেই পড়ে। মাছ-মাংস না থাকলেও ডিম হলেই চলে যায়। কিন্তু সেই ডিমের দামও বেড়েই চলেছে সমানতালে।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম বেড়েছে ডজন প্রতি ৩০ টাকা। ডিমের মতোই বেড়েছে মুরগির মাংসের দাম। গত সপ্তাহে বয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছিল কেজিতে ১৫৫ টাকা। আর সেই বয়লার বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। কোনো কোনো জায়গায় এলাকাভেদে ২১০ টাকা।

গতকাল শনিবার শহরের বড়বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ১০০’শ ডিম বিক্রি হচ্ছে পাইকারি দরে ১১৪০-১১৫০ টাকা। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে মুরগির খাবার সময়মতো আসছে না। তাছাড়া হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে পরিবহন খরচ বেড়েছে একারণে ডিমের দাম বেড়েছে এমনকি জানালেন ব্যবসায়ীরা।

বড় বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী রহমান স্টোরের স্বত্বাধিকারী ওবায়দুর রহমান বলেন, গত এক সপ্তাহে আগে ১০০’শ লাল ডিম ৯০০’শ টাকায় বিক্রি করেছি। তাতে লাভ হয়েছিল মাত্র ২০ পয়সা। সাদা ডিম ৮৫০ টাকায় বিক্রি করছি। সেখানে লাভ হয় ১৮ পয়সা। আর এখন লাল ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে, ১০০’শ লাল ডিম ১১৫০ টাকা। সাদা ডিম ১১৩৫ টাকা। তাছাড়া ডিম ভেঙে গেলে তার দায়ভার আমাদেরকে বহন করতে হয়।

বড় বাজারের আরেক ব্যবসায়ী মেসার্স তাহের এন্ড সন্স’র মালিক মোহাম্মদ হাসান বলেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে মুরগির খাবার আসছে না। গত ৪ মাস ধরে এই অবস্থা। তিনি বলেন, শীতের পর গরম শুরু হয়েছে। এসয়টাতে মুরগি সবথেকে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। যাকে রাণী ক্ষেত রোগ বলা হয়। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রচুর মুরগি মারা যাচ্ছে, তাই ডিমের উৎপাদনও কমে গেছে। এতে চাহিদা অনুযায়ী কিছুটা সংকটও রয়েছে। এসবের প্রভাবেই বাজার এখন চড়াও।

মেসার্স হোসেন এন্ড ব্রাদার্স’র সাইফুল ইসলাম সিকদার বলেন, পরিবহন খরচ বেড়েছে। তাই ডিমের দামও বেড়েছে। এখানে আমাদের করার কিছু নেই।

নাম জানাতে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, আড়তদার, পাইকারি ও পোল্ট্রি ফিড’র লোকজন মিলে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে তাই বলে এক লাফে এতো টাকা বাড়তে পারেনা। প্রশাসন অভিযান চালালে সব বেরিয়ে আসবে। হঠাৎ করে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। চাল ও কাঁচামরিচ, ভোজ্যতেল, ডিম ও সব ধরনের সবজির দাম অস্বাভাবিক। মরিচের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ‘ট্রিপল সেঞ্চুরি’ করেছে। খুচরা বাজারে মরিচ বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ২৮০-৩০০ টাকা।

এদিকে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। কেননা এসব পরিবারে আমিষের ঘাটতি পূরণে অন্যতম ভূমিকা রাখে ডিম। গত কয়েকমাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী ডিমের দাম। দাম না কমায় বাধ্য হয়ে ডিম কেনা থেকে বিরত থাকছেন অধিকাংশ ক্রেতা।

নতুন বাহার ছড়া এলাকার বাসিন্দা নুরুল কবির বলেন, গত সপ্তাহে ১ডজন ডিম কিনেছিলাম ১২৫ টাকা। আজকে সেই ডিমের দাম বলছে, ১৪৮ টাকা।

টেক পাড়ার বাসিন্দা লোকমান হাকিম বলেন, আজকে বাজার থেকে বয়লার মুরগি কিনলাম কেজিতে ২০০ টাকা। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার। আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসেব মেলাতে পারছিনা। সবকিছুর দাম বাড়তি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার খামার মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল হক বলেন, গত সপ্তাহে ডিমের দাম মুটামুটি কম ছিলো। জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে পরিবহন খরচ বেড়েছে। তিনি বলেন, মুরগির খাদ্য, পরিবহন খরচ এবং একইসঙ্গে মুরগি চাষের আনুষঙ্গিক সব খরচই বেড়েছে তুমুল ভাবে। ডিম আনার পর লোডিং–আনলোডিং করার খরচও বেড়েছে। তাতেই বাড়ছে ডিমের দাম।

তথ্য মতে, জেলায় ডিম উৎপাদন হয় দৈনিক ১৫ লাখ। চাহিদা রয়েছে ৫ লাখ পিচ। শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১ লাখের মতো ডিম লাগে। বাকি ডিম লোহাগাড়া, সাতকানিয়া এবং চট্টগ্রামে চলে যায়। তারমধ্যে লাল ডিম উৎপাদন হয় মাত্র ২০% এবং সাদা ডিম উৎপাদন হয় ৮০ %।

এতো ডিম উৎপাদনের পরেও কেন ডিমের দাম বেশি এমন প্রশ্নে আবদুল হক বলেন, মুরগির খাবারের দাম অনেক বেশি। গত একবছর আগে ৫০ কেজি বস্তা ১৪০০-১৫০০ টাকায় পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন সেই বস্তা কিনতে হচ্ছে ২৭০০-২৮০০ টাকা দিয়ে। তাছাড়া রাণিক্ষেত রোগ আসলে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, প্রতি পিচ ১১ টাকায় পাইকারি বিক্রি করলেও পোষাচ্ছেনা। মনে হয় সামনে ডিমের দাম আরও বাড়বে।

বাজারে মাছ, মাংসের দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী , তখন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নিত্যদিনের খাবারে ডিমের চাহিদা ব্যাপক। কিন্তু দাম বাড়ায় চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে ওইসব পরিবারগুলো। বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে প্রতি পিস বয়লার মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১-১২ টাকায়। যা আগে বিক্রি হতো ৮-৯ টাকা করে। অর্থাৎ ১১০ টাকা ডজনে বিক্রি হওয়া ডিম খুচরা বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘সামনে ডিমের দাম আরও বাড়তে পারে।’ তারা ডিমের দাম বৃদ্ধির ৪টি কারণ উল্লেখ করেছে। প্রথমত, পোলট্রি ফিডের দাম বৃদ্ধি, হাঁস মুরগীর রানিক্ষেত রোগে প্রচুর ক্ষতি ও গ্রাম পর্যায়ে খামার বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বেড়েই যাওয়া।

এদিকে বাজারে বয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ২০০-২১০ টাকা, লাল ( পাকিস্তানি) ৩২০-৩৫০ টাকা, সোনলী ২১০-৩৫০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৯০-৩১০ টাকা এবং দেশি মুরগি ৪৫০-৪৮০ টাকা দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে।

কক্সবাজারের বৃহৎ পাইকারি বাজার বড় বাজারের চাউল বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। পাইকারি বাজারে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে ২৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত। খুচরায় কেজিতে বেড়েছে ৬-১০ টাকা পর্যন্ত। শুধু মুরগী ডিম চাল মরিচ নয়, তেল, চাল-ডালসহ প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি। এতে করে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যআয়ের পরিবারগুলো।

জানতে চাইলে কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান বলেন, আমরা শনিবার হোটেল-মোটেল জোনে অভিযান পরিচালনা করেছি। কেউই যাতে খাবারের বাড়তি দাম নিতে না পারে এজন্য সকল ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছে।

নিত্যপন্যের বাজারে অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলেছি। আমরা আজ রবিবার সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করবো। জ্বালানি তেলের অজুহাতে কেউ যদি অতিরিক্ত বাড়তি দাম নেয় তাকে জরিমানা প্রদান করা হবে এবং সতর্ক করা হবে।

আরও খবর