ডেস্ক রিপোর্ট •
পুলিশের মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ পুলিশ সুপার (এসপি)। একটি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটা ওই জেলার এসপির যোগ্যতা, সততা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। শিগগির কক্সবাজারসহ ৩০ জেলার এসপি পদে রদবদল আসছে। পদোন্নতির কারণে এরই মধ্যে ২৫ জেলার এসপি পদ শূন্য হয়েছে। ওই জেলার এসপিরা এরই মধ্যে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি হয়েছেন। প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি বড় জেলায় পুলিশ সুপার পদেও নতুন মুখ আসছে। গুরুত্বপূর্ণ জেলার এসপি হতে এরই মধ্যে নানামুখী লবিং ও তদবিরও শুরু হয়েছে।
একেকটি বড় জেলার জন্য চার-পাঁচজনও সম্ভাব্য প্রার্থী রয়েছেন। গুঞ্জন আছে, বড় জেলার এসপি হতে কেউ কেউ টাকা ঢালারও চেষ্টা করছেন। অনেকে আবার রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে তদবির করাচ্ছেন। ভালো পদায়ন পেতে একজন সাবেক আমলার প্রভাবের কথা শোনা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কার কার ভাগ্যের চাকা খুলবে- এটা নিয়ে রয়েছে নানা মতও। এখন যাঁরা এসপি হিসেবে পদায়ন পাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জেলায় দায়িত্ব হিসেবে থাকতে পারেন। অনেককে আবার রদবদল করা হবে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে যোগ্য অফিসার নির্বাচনে পুলিশের জন্য একটি ফিটলিস্ট তৈরি করা। তবে আজও এসপি পদে দক্ষ কর্মকর্তাদের বাছাই করতে ফিটলিস্ট করা যায়নি। তবে পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, পুলিশের বর্তমান প্রশাসন পুলিশ ইন্টারনাল ওভারসাইটের (পিআইও) মাধ্যমে কর্মকর্তাদের গোপন প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে ওই কর্মকর্তার সততা, যোগ্যতা ও দুর্বলতার বিষয়গুলো থাকে। এ ছাড়া একাধিক সংস্থার মাধ্যমে কর্মকর্তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হয়। পদায়নের ক্ষেত্রে এসব প্রতিবেদনের তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
পদোন্নতির কারণে যে ২৫টি জেলার এসপি পদে নতুন মুখ আসতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে- কক্সবাজার,ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাঙামাটি, খুলনা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী। এর বাইরে আরও ৫-৬টি জেলার পুলিশ সুপার পদে রদবদলের সম্ভাবনা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল ঘিরে তদবির বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এসপি পদে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের মধ্যে বিসিএস ২০, ২১, ২২, ২৪ ও ২৫ ব্যাচের। নতুনভাবে এসপি পদে যাঁরা আসতে পারেন, তাঁদের মধ্যে ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচ রয়েছে। তবে এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫ জনের মতো ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তা এসপি হতে পারেন। আর ২৭ ব্যাচ থেকে এসপি হতে পারেন ৭-৮ জন। বাকিরা ২৪ ব্যাচের। এসপি হওয়ার তালিকায় ২৭ ব্যাচের মধ্যে মোহাম্মদ রাসেল শেখ, মোহাম্মদ মাসুদ আলম, মাহাবুজ্জামান, সাইফুর রহমান, মুস্তাফিজ, আনসার উদ্দিনসহ আরও কয়েকজনের নাম আলোচনায় রয়েছে।
এ ছাড়া এসপি হিসেবে সিআইডিতে কর্মরত এক নারী কর্মকর্তাও আলোচনায় আছেন। ঢাকা জেলার এসপি হিসেবে ডিবির মতিঝিল বিভাগের ডিসি রিফাত রহমান শামীম, নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম ও গুলশান বিভাগের ডিসি মো. আসাদুজ্জামানের নাম আলোচনায় রয়েছে।
এ ছাড়া অন্য যাঁরা জেলার এসপি হওয়ার দৌড়ে আছেন, তাঁরা হলেন-গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক ডিসি মো. শহীদুল্লাহ, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ডিসি আব্দুল মান্নান, ডিবির উত্তরা ডিসি কাজী শফিকুল আলম, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি শাহ ইফতেখার আহমেদ, ডিবির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ওয়াহিদুজ্জামান ও ডিবির রমনা বিভাগের ডিসি এইচ এম আজিমুল হক, বরিশাল মহানগর ডিসি আলী আশরাফ ভূঁইয়া ও এস এম তানভীর আরফাত, এসবির বিশেষ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান ও মোহাম্মদ মতিয়ার রহমান।
পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা এই প্রথম জেলায় এসপি হতে যাচ্ছেন। এই ব্যাচের যোগ্যদের বাছাই করে মাঠে বড় দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া এসপি হওয়ার পরও ২৭ ব্যাচের ৩৮ জন কর্মকর্তা প্রায় এক বছর কোনো পদায়ন পাননি। পদ না থাকায় পুলিশ সদরদপ্তরে তাঁরা সংযুক্ত ছিলেন।
২০২১ সালের ৪ মে ২৭তম ব্যাচের ৬৩ অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে পদোন্নতি দিয়ে এসপি করা হয়। তাঁদের মধ্যে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে ১৫ জনকে পদায়ন করা হয়। বাকি ৪৮ জনকে র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের উপপরিচালক হিসেবে পদায়নের জন্য পাঠানো হয়। র্যাব থেকে জানানো হয়, বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে উপপরিচালকের পদ খালি আছে ৯টি। শূন্য এসব পদে ৯ জন এসপিকে রেখে বাকি ৩৯ জনকে ফিরিয়ে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায় র্যাব। পরে ৩৯ জনের র্যাবে পদায়ন বাতিল করে তাঁদের পুলিশ সদরদপ্তরে সংযুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁদের মধ্যে একজনের ফোনে ‘শৃঙ্খলাবিরোধী’ কথোপকথন ফাঁস হলে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এসপি পদে নিয়োগ দেওয়ার আগে নিরপেক্ষভাবে ওই কর্মকর্তার সব তথ্য জানা থাকা জরুরি। এসপি হতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন এমন কয়েকজনের বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে সরাসরি ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে নানা পদে কাজ করে আসায় তাঁদের অতীত কর্মকাণ্ড এরই মধ্যে ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, পুলিশে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদায়নের বিষয় সামনে এলেই অনেক সময় বাহিনীর ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। পুলিশের বাইরের প্রভাবশালী লোকজনও নিজেদের পছন্দের লোকজনকে ভালো জায়গায় বসাতে চান। এই কারণে অনেক সময় দক্ষ কর্মকর্তারা বঞ্চিত হন।
পুলিশ সদরদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশ বাহিনীতে তিন সহস্রাধিক ক্যাডার অফিসার রয়েছেন। এর মধ্যে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার পদ একটি ও গ্রেড-১ পদ দুটি। এ ছাড়া অতিরিক্ত আইজিপির পদ রয়েছে ২২টি। ডিআইজি পদসংখ্যা ৮৫। অ্যাডিশনাল ডিআইজির পদ ২০০ ও এসপির পদ সাত শতাধিক। আগে এসপির পদ কম থাকায় অনেকে একাধিক জেলায় পুলিশ সুপার হওয়ার সুযোগ পেতেন। এখন এসপির পদ বাড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী বেড়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, এসপি ও মহানগরে ডিসি পদে যোগ্য লোক নির্বাচনে একটা নীতিমালা ও ফিটলিস্ট থাকা দরকার। ওসি নিয়োগের জন্য একটা নীতিমালা করা আছে। সেখানে বলা আছে, কারও বয়স ৫৪ বছর হয়ে গেলে ওসি হতে পারবেন না। এসপির বেলায় এ ধরনের নীতিমালা সময়ের দাবি। কারণ, এখন একেকটি পদের বিপরীতে অনেক প্রার্থী। আর শৃঙ্খলা বাহিনীতে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে ভালোভাবে স্ক্যানিং করা জরুরি। রাষ্ট্রের নীতির প্রতি ওই কর্মকর্তা কতটা অনুগত, সেটা জানা দরকার। তাঁর কোনো গোপন এজেন্ডা রয়েছে কিনা সেটা জানতে হয়।
গত ১১ মে ৩২ জন অতিরিক্ত ডিআইজি পদোন্নতি পেয়ে ডিআইজি হয়েছিলেন। প্রায় ৯ মাস আগে গত বছর ডিআইজিদের এসব পদ সৃষ্টি করা হয়। পদ তৈরির ৯ মাস পর তাঁরা পদোন্নতি পান। পদোন্নতির এক মাস পর তাঁরা পেলেন পদায়ন। ডিআইজিদের পদোন্নতির পরপরই দুই দফায় এসপি থেকে অতিরিক্ত ডিআইজি হয়েছেন ১১৯ জন কর্মকর্তা। ৩ জুন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে পুলিশ সুপার হয়েছেন আরও ৩৩ জন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-