ইত্তেফাক •
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা একটি মামলায় সাজা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের করা মাদকের তালিকায় ‘গডফাদার’ হিসেবে শীর্ষে নাম থাকায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পাননি দেশের আলোচিত-সমালোচিত সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। নিজের বউকে মনোনয়ন নিয়ে দিয়ে এমপিও বানিয়েছেন। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ।
টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের আজকের (২৪ জুলাই) সম্মেলন ও কাউন্সিলে তিনি সভাপতি পদে লড়বেন বলে প্রচারণা চলছে। তার শুভার্থী অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টার ছেড়ে তা প্রচার করছেন। বদির সাথে প্যানেল বলে প্রচার করছেন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী এম এ বাহাদুরও। পৌর আওয়ামী লীগের শীর্ষ এ পদ বদি বাগিয়ে নিতে যাচ্ছেন এমনটি ভেবে বদি বিরোধীদের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে, বদির সভাপতি প্রার্থী প্রচারণার পর দলীয় ফোরামে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। দলকে নতুন করে সাজাতে তৃণমূল কিংবা শহরে মাদক ও দূর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের দলীয় পদে না রাখার কেন্দ্রীয় ঘোষণার পর সাজাপ্রাপ্ত হয়েও সাবেক এমপি বদি যদি প্রার্থীতা ঘোষণা করেন, তা দলীয় হাইকমান্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সামিল বলে উল্লেখ করেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক নেতা-কর্মী।
তাদের মতে, কেন্দ্রীয় ঘোষণার অনুবলে উখিয়ার রত্নাপালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সম্পাদক সৈয়দ মো. নোমানকে প্রার্থী হতে দেয়নি সাংগঠনিক টিম। নোমানকে ঢাকার একটি মাদক মামলায় আসামীর স্বীকারোক্তি মতে অতিরিক্ত আসামী হিসেবে চার্জশীট ভুক্ত করা হয়েছে। মামলাটি এখনো চলমান। একইভাবে জালিয়াপালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সম্মেলনে মুছা মেম্বারকেও প্রার্থী হতে দেয়নি সাংগঠনিক টিম। তাকেও একটি ইয়াবা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং সেই মামলাও এখনো চলমান।
নোমান ও মুছা মেম্বারের মতে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আমরা ইয়াবা মামলায় আসামী হয়েছি। আমরা শুরু হতে ইয়াবার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছি। এরপরও আসামী হয়েছি- মামলা চলমান, এখনো আমাদের অপরাধ প্রমাণ হয়নি। কিন্তু দোষী সাব্যস্ত করে আমাদের অধিকার হরণ করা হয়েছে।
তবে, ভিন্ন ইউনিয়নে প্রকৃত ইয়াবা কারবারি ও একাধিক মামলা থাকার পরও অনেকে প্রার্থী হয়ে পদের অধিকারীও হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে কাজ করা অনেকেই সভাপতি-সম্পাদকের পদ পেয়েছেন। দল এক, কিন্তু দ্বৈত নীতি দেখে কষ্ট লাগে। বিমাতা সুলভ আচরণ কখনো কাম্য নয়।
অপরদিকে, সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রার্থী বলে তার শুভার্থীরা নানা ভাবে প্রচার করলেও নিজেকে এখনো প্রার্থী ঘোষণা দেননি বলে উল্লেখ করেছেন বদি। কিন্তু পৌর কাউন্সিলর, পৌর আওয়ামী লীগ নেতা এবং কাছের কয়েকজন সাংবাদিকও বদির প্রার্থীতার বিষয়টি প্রচার করেছেন-
এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বদি বলেন, আমার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক, সাংগঠনিক টিমকে আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমি আমার প্রার্থীতার বিষয়ে কিছু বলেছি কি না?
আমার শুভার্থী অনেক, আমাকে ভালোবেসে কে কি প্রচার করছে তা জানি না- জেলা সদর কিংবা টেকনাফের আমার কাছের কোন সাংবাদিককেও আমি বলেছি বলে প্রমাণ নেই, যোগ করেন বদি।
বদির দাবি, আমার ঘোষণা না থাকলেও আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রচারণায় কিছু জনবিচ্ছিন্ন নেতা পদ হারানোর ভয়ে আতংকে ভুগছেন। বলতে পারেন তারা ‘বদি জ্বরে- জলে পুড়ে মরছেন’।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামীলীগ নেতারা বলেন, বদিকে দলীয় শীর্ষ পদবিধারী হওয়ার সুযোগ দিলে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন। দুর্নীতি মামলায় সাজা ও মাদকের গডফাদার তালিকায় শীর্ষ নাম থাকায় দলের ব্যাপক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বদির কারণে। এখন আওয়ামী লীগের বড় পদবী পেলে আওয়ামীলীগের সুখের সংসারে আগুন লাগার মতো হবে। তবে, টেকনাফে তার আধিপত্য থাকায় চলে-বলে কৌশলে পদটি বাগিয়ে নিতে পারেন বদি, এমন আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, বদির ‘বদ নিঃশ্বাস’ চারপাশে বিষ ছড়িয়ে এসেছে। দূর্নীতি, মাদকের ‘গডফাদার’ হিসেবে দেশজুড়ে সমালোচিত সাবেক এমপি বদি। নিজের অপরাধকর্ম আরো নির্বিঘ্ন করতে এখন দলীয় উচ্চ পদ বাগাতে কৌশলে এগুচ্ছে। তিনি শীর্ষ পদে আসীন হলে এটা আওয়ামী লীগের জন্য অকল্যাণ। তিনি এখানকার আওয়ামী লীগকে ‘বদি লীগে’ পরিণত করবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলার শীর্ষ এক আওয়ামীলীগ নেতা বলেন, আবদু রহমান বদিকে দলীয় শীর্ষ পদে দেয়া মানে মাদক কারবারি ও দুর্নীতিবাজদের উৎসাহীত করা।এমনটি হয়ে থাকলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
পাশাপাশি টেকনাফে আওয়ামীলীগে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন এ নেতা।
টেকনাফ পৌরসভা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি সভাপতি প্রার্থী হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের উখিয়া-টেকনাফ সাংগঠনিক টিম প্রধান জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহ আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলম বলেন, বদি সরাসরি কিছু না বললেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নানা প্রচারণায় তার প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি জেনেছি। যেহেতু দুর্নীতি মামলায় তার একটিতে সাজা ও অপর একটি মামলা চলমান, তিনি প্রার্থী হলে করণীয় জানতে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক টিমকে লিখিত জানতে চাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে নির্দেশনা যেমনটি পাবো সেভাবে কাউন্সিল সম্পন্ন করা হবে। যেহেতু ভিন্ন ইউনিয়নে আমারা মাদকের বিষয়ে জিরোটলারেন্স দেখিয়েছি, বদির বিষয়েও যেন কোন বিতর্ক না উঠে আমরা সচেষ্ট রয়েছি।
উল্লেখ্য, সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০১৬ সালে ২ নভেম্বর দুদকের দায়ের করা মামলায় আলোচিত সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিকে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং দশ লাখ টাকা জরিমানা করে রায় দিয়েছিল আদালত।
২০০৭ সালে ১৭ ডিসেম্বর দুদক চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বদির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাটি দায়ের করেন। ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর দুদকের এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিন সপ্তাহ কারাগারে ছিলেন আব্দুর রহমান বদি। পরে তিনি হাই কোর্টের অন্তর্র্বতীকালীন জামিনে মুক্তি পান।
এর আগে ২০১৫ সালের ৭ মে দুদকের উপ-পরিচালক মঞ্জিল মোর্শেদ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে বদির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্রে বদির ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৯৪২ টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য তুলে ধরা হয়। বলা হয়, তিনি দুদকের কাছে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৫৩ হাজার ২৭ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে দুর্নীতির এই মামলায় বদির বিচার শুরু করে আদালত। মোট ১৩ জনের সাক্ষ্য শেষে ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বার বিচারক রায় ঘোষণা করেন।
সর্বশেষ ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বদির পক্ষে প্রথমে অভিযোগ গঠন বাতিলের আবেদন করেন তার আইনজীবী এ আর হাসানুজ্জামান। ২০২২ সালে ২২ মে, আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগের মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে মামলাটি এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এতসব কিছুর পরও টেকনাফ পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আসীন হতে আবদুর রহমান বদি নিরবে হাঁটছেন বলে প্রচার পাচ্ছে। তবে, রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতীক্ষা করতে হচ্ছে- বদি কি কারিশমা দেখাচ্ছেন।
উখিয়া-টেকনাফ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি জেলা আওয়ামীলীগ নেতা রাজা শাহ আলম জানিয়েছেন, রোববার (২৪ জুলাই) টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, বিশেষ অতিথি হয়ে ইউনুছ বাঙ্গালী, সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদি অংশ নিবেন। পৌর আওয়ামীলীগের সি. সহসভাপতি ইউছুপ মনু সভাপতিত্ব উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মাষ্টার জাহেদ হোসেন উদ্বোধক ও সা. সম্পাদক নূরুল বশর প্রধান বক্তার বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-