আবদুল্লাহ আল আজিজ, কক্সবাজার জার্নাল •
উখিয়ায় বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত বছরের এ সময়ের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যান বলছে সর্বশেষ গত ১৮ জুলাই ২৪ ঘন্টায় উখিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৬ জনে দাঁড়িয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। আক্রান্তদের বেশীরভাগই রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিওতে কর্মরত। সেখানে কাজ করতে গিয়ে বেশীরভাগই আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে ঘনবসতি বেশি এবং থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় সেখানে পানি জমে থাকছে। এছাড়া অবস্থান ও পরিবেশগত কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘিঞ্জি পরিবেশে অবস্থিত। প্রতিটি ঘরে ৮ থেকে ১০ জন গাদাগাদি করে থাকে। পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে মশা জন্মানোর সুযোগ বেশি। অপর দিকে মশার লার্ভা ও উড়ন্ত মশা মারার উদ্যোগও কম। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যেও সচেতনতারও অভাব আছে।
সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। এখন দৈনিক দেড়শ থেকে ২শ রোগী ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ক্যাম্পের হাসপাতাল গুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর কোন রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলেই কেবল ক্যাম্পের হাসপাতালগুলো থেকে জেলা সদর হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের চিকিৎসা সমন্বয়ক ডা. আবু তোহা জানান, রোহিঙ্গা শিবিরে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের হার অনেক। চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চারমাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের মোট সংখ্যা ছিল ২শ’র কম। আর মে মাস থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে।
তিনি জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলতি বছরের ১ম চার মাসে ডেঙ্গু ধরা পড়ে ১৭২ জনের। এরপর মে মাস থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে আগে যেখানে প্রতিমাসের পরিসংখ্যান রাখা হতো, সেখানে এখন প্রতি সপ্তাহের পরিসংখ্যান রাখা হচ্ছে।
ডা. তোহা জানান, জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ আকার ধারন করেছে ডেঙ্গু। এখন প্রতি সপ্তাহে আক্রান্তের হার হাজার ছাড়িয়েছে।
তিনি জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু ধরা পড়ে ৮৪ জনের, ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ৯ জনের, মার্চ মাসে ১৭ জনের এবং এপ্রিলে ৬২ জনের। এরপর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ১৮ জন, দ্বিতীয় সপ্তাহে ৪৫ জন, তৃতীয় সপ্তাহে ৭৬ জন এবং চতুর্থ সপ্তাহে ৯৭ জন ডেঙ্গুরোগী ধরা পড়ে।
জুন মাসে এসে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়েছে এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ৩০ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত এক সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ২৪২ জন। এরপর গত জুন এক মাসেই আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
তবে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ‘সিরিয়াস কেস’ নেই বলে জানান ডা. তোহা।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রনজন বড়ুয়া রাজন জানান, রোহিঙ্গা শিবিরে ডেঙ্গুর অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক জানিয়ে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একদিকে খুব ঘনবসতি, অন্যদিকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অপ্রতুল। পরিবেশ ও অবস্থানগত কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের হার দিন দিন বাড়ছে। ’
তিনি আরও বলেন, বর্ষাকালে চিপসের প্যাকেটসহ প্লাস্টিকের নানা বর্জ্যে পানি জমে থাকে। আর এই প্যাকেটগুলোই এডিস মশা প্রজননের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠেছে।
তিনি ডেঙ্গু প্রতিরোধে যেখানে সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলা, ঘরের আশেপাশে পরিষ্কার রাখা ও রাতের বেলায় ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
অন্যদিকে, মশার উপদ্রবে নাজেহাল উখিয়ার বেশির ভাগ এলাকার মানুষ। তবে নেই সচেতনতা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ। এমনকি ডেঙ্গু শনাক্ত রোগীর এলাকায়ও সচেতনতা বাড়াতে নেই কোনো কার্যক্রম। শঙ্কা দেখা দিয়েছে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠার।
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা কাউকে কামড়ালে ওই ব্যক্তি কয়েকদিনের মধ্যে এই জ্বরে আক্রান্ত হয়। এভাবে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এতে রোগীর কষ্ট আরও বেড়ে যায়।
সাধারণত বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা খোলা পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা প্রভৃতি স্থানে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। কাজেই নাগরিকরা সতর্ক থাকলে সহজেই এ মশার বিস্তার রোধ করা যায়।
উখিয়ার এক বাসিন্দা বলেন, মশা অনেক বেশি। ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।
আরেক বাসিন্দা বলেন, অলিগলিতে অনেক মশা। ডেঙ্গু মশার কামড়ে অনেক মানুষ ভর্তি হয়েছে উখিয়া হাসপাতালে। আমি গিয়ে দেখেছি ১০ জন ভর্তি হয়েছে।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মহিউদ্দীন মাহিন জানান, আমার হাসপাতালে গড়ে ৮-১০ রোগী প্রতিদিনই থাকছে। যদি বাড়ে, এর জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। চিকিৎসকরা সব ধরনের সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। যে কারণে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানালেন এই বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, আনাচে-কানাচে যে পরিত্যাক্ত পাত্রগুলো থাকে, সেগুলোতে বৃষ্টির পানি জমা হয় এবং সেখানে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এতে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে যায়।
উখিয়া প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রতন কান্তি দে জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ও উখিয়ার বিভিন্ন ঝোপঝাড় স্থানে জরুরিভাবে এডিস মশা নিধনে ওষুধ ছিটানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচার প্রচারণা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে কীটনাশকযুক্ত মশারী বিতরণ করা দরকার।
তিনি এ কার্যক্রম নিয়মিত জোরদার ও প্রশাসন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং সংশ্লিষ্ট এনজিও গুলোকে মাঠে নামার আহবান জানান।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-