তোফায়েল আহমদ,কালের কন্ঠ :
মামলার এজাহার ও নিম্ন আদালতের অর্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে কক্সবাজারের একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কিলার (এজাহারের বিবরণ মতে) হাইকোর্টের জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
তিনি ইতিমধ্যে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এর আগে শাহীন নামের উক্ত আসামির এক ছেলেও হাইকোর্ট থেকে ৪ সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়ে ইতিমধ্যে দুবাই পাড়ি জমিয়েছেন।
হত্যা মামলার বাদি এমন তথ্য দিয়ে বুধবার কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আবেদন জানালে বিজ্ঞ বিচারক জরুরি ভিত্তিতে মুখ্য বিচারিক আদালত থেকে মামলার তলব করেছেন।
দেশের উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালত পর্যন্ত জালিয়াতচক্র একের পর এক এক ধরনের জাল জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। বিশেষ করে জালিয়াতচক্র কক্সবাজারকে জালিয়াতি কাজের অন্যতম টার্গেট করে নিয়েছে রোহিঙ্গা এবং ইয়াবারাজ্যেও নানা অপরাধ ও খুন-খারাবির মামলা নিয়ে। এতে করে জালিয়াতচক্র একদিকে বিপুল অংকের টাকা রোজগার করে নিচ্ছে অপরদিকে দেশ ও বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস পাচ্ছে।
এ ঘটনায় কক্সবাজারের আদালত পাড়ায় তোলপাড় চলছে। স্থানীয়রা বলছেন, কক্সবাজারেও একটি বড় জালিয়াতচক্র দীর্ঘদিন ধরে হত্যা, ইয়াবাসহ রোহিঙ্গাদের নানা চাঞ্চল্যকর মামলার জাল জালিয়াতিতে জড়িত রয়েছে। ইতিমধ্যে শাহাবুদ্দিন নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের একটি জালিয়াত চক্র দীর্ঘদিন ধরে এ কাজে জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কক্সবাজার আদালত পাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে টাউট-বাটপার ও জালিয়াত চক্রের উৎপাতের অভিযোগ অনেক পুরানো। এজন্য জেলা আইনজীবী সমিতির তৎপারতা সত্বেও টাউটদের তৎপরতার হ্রাস পায়নি।
সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন সমিতির সদস্যরা টাউট-বাটপারদের উৎখাতে আন্তরিক। সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল আনোয়ার বলেছেন, সমিতি টাউট-বাটপার নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন করেছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি দুই আদালতেই এ কমিটির কার্যক্রম রয়েছে।
আদালতপাড়ার টাউট-বাটপার উৎখাত কমিটির অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট রিদুয়ান আলী বলেছেন- ‘আমরা জুনিয়র আইনজীবীরা টাউট-বাটপারদের দেখা মাত্রই ধরে ফেলি। তাদের ছবি টাঙিয়ে দিই আদালতপাড়ায়। এসব লোকদের প্রতিহত করার জন্য সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে আসছি আমরা। কিছুদিন টাউট-বাটপাররা ঘাপটি মেরে থাকে কিন্তু পরে আবার উঠে আসে। তারপরও আমরা থামব না। ’ তিনি মোরশেদ বলী হত্যার অন্যতম আসামিকে জামিনে বের করে আনার হোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনে নামারও ঘোষণা দেন।
কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানিয়েছেন, গত ৭ এপ্রিল রমজান মাসে ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে স্থানীয় পিএমখালী বাজারে প্রকাশ্যে এ লোমহর্ষক হত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল। ওই এলাকার মোরশেদ বলী (৩৮) নামের রোজাদার ব্যক্তিটি বাজারে ইফতার কিনতে আসা মাত্র ২৫/৩০ জনের হত্যাকারীর দল তাকে ঘিরে ধরে দা, লাঠি ও লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হতা করে।
এ বিষয়ে নিহত মোরশেদ বলীর ছোট ভাই জাহেদ আলী বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে ৩০/৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। বাদী জানান, এ পর্যন্ত ১৬ জন আসামি আটক হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
বাদী আরো জানান, গত ৩০ জুন হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও মাননীয় বিচারপতি খন্দকার দিলোরুজ্জামানের বেঞ্চে ক্রিমিনাল মিচ কেইচ নং ৩৩২৯৪/২০২২ দায়েরপূর্বক মামলার ২ নম্বর আসামি মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদের জামিন প্রার্থনা করা হয়।
বাদীর অভিযোগ, ওই বেঞ্চে আসামির জামিনের আবেদনের সঙ্গে দেওয়া এজাহারের মূল কপিতে ২নং আসামি হলেও তা পরিবর্তন করে দেখানো হয়েছে ২২নং আসামি। হত্যার অভিযোগের বিবরণও এজাহার থেকে মুছে ফেলা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া আসামি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বেচ্ছায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা ১৬৪ ধারার জবানবন্দির মাধ্যমে স্বীকার করলেও তা গোপন রাখা হয়। এমনকি কক্সবাজারের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত ও জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অর্ডারের কপির অবিকল কপিও পরিবর্তন করা হয়।
প্রসঙ্গত, জামিন নিয়ে পলাতক আসামি মোহাম্মদ ও সৈয়দ নামের দুই ভাই দীর্ঘকাল ধরে সৌদি আরব বসবাস করে আসছেন। তারা কয়েক কোটি টাকা বিনিময়ে বাংলাদেশে মিশন নিয়ে আসেন মোরশেদ আলী বলীকে হত্যা করার জন্য।
কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর বলেছেন, এজাহার ও নিম্ন আদালতের অবিকল নকল কপি ঠিকই সরবরাহ করা হয়েছে। হাইকোর্টে আবেদন করার আগেই জালিয়াতচক্র সকল নথির কাগজপত্র জাল করেই আইনজীবীকে দিয়ে আবেদন দাখিল করেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ বিষয় নিয়ে প্রতিকার চেয়ে বুধবার কক্সবাজারের দায়রা জজ আদালতে বাদী জাহেদ আলী একটি আবেদন দায়ের করেছেন (ক্রিমিনাল মিচ মামলা নং ৩২৫১/২০২২)। আদালত মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালত থেকে জরুরি নথি তলবের আদেশ দিয়েছেন। বাদীর নিয়োজিত আইনজীবী আমীর হোসাইন জানিয়েছেন, আজ বৃহস্পতিবারই জজ আদালতে মামলাটির শুনানি হওয়ার আশা করছেন।
মামলার বাদী আরো জানান, এর আগে ২নং আসামি মোহাম্মদের এক ছেলে শাহিনও উচ্চ আদালতের অন্তর্বতীকালীন জামিন নিয়ে দুবাই পাড়ি দিয়েছেন। তার অপর ছেলে নারী ও শিশু আদালত থেকে জামিনে গিয়েছেন। বাদী তারও জামিন বাতিল চেয়ে ইতিমধ্যে মিচ মামলা করেছেন।
এদিকে হাইকোর্টের জামিন আদেশ নিয়ে কক্সবাজারের মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে জামিনদার হওয়া স্থানীয় আইনজীবী আশীষ বড়ুয়া জানিয়েছেন, গত ৬ জুলাই উক্ত আসামি কক্সবাজার কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন। কক্সবাজারের লিংক রোড মুহুরিপাড়ার শাহাবুদ্দিন নামের একজন তদবিরকারি মামলাটি নিয়ে হাইকোর্ট পর্যন্ত তদবির করেছেন। উক্ত শাহাবুদ্দিন আরো নানা মামলার তদবির নিয়ে ঢাকা-কক্সবাজার ছুটাছুটি করে থাকেন।
এদিকে হাইকোর্ট বেঞ্চের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী নূরুল হুদা আনসারী বুধবার রাতে বলেছেন, তিনি হত্যা মামলার আসামি জামিন নিয়েছেন কক্সবাজারের মামলা মোকদ্দমার তদবিরকারি শাহাবুদ্দিনের দেওয়া কাগজপত্র নিয়েই। তিনি বিষয়টি জেনে হতবাক হন বলে জানান। আজ বৃহস্পতিবারই তিনি ওই জাল তথ্য দিয়ে জামিনপ্রাপ্ত আসামির জামিননামা প্রত্যাহারের আবেদন জানাবেন বলেও জানান।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-