অজানা চর্মরোগের প্রার্দুভাবে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লক্ষাধিক মানুষ ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। মিলছে না ঠিক মত ওষুধ। প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে ক্যাম্পগুলোতে। স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থা এগিয়ে এলেও প্রতিকার হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবার্তায় ক্যাম্পে এটি মহামারী আকার ধারণ করতে যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ক্যাম্পের ঘরে ঘরে অজানা চর্মরোগ বাসা বেঁধেছে। গত এক বছর ধরে আক্রান্ত শিশুসহ অন্তত লক্ষাধিক মানুষ। মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ ও শিশু সবাই এ রোগে আক্রান্ত। আক্রান্তদের বেশিরভাগই হতদরিদ্র হওয়ায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। ক্যাম্পজুড়ে অজানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এছাড়াও এ চর্মরোগে আক্রান্তদের শরীরে দগদগে ঘা হওয়ায় কেউই তাদের সঙ্গে মিশছে না। আক্রান্ত পরিবারের ছেলেমেয়ের পাশে দোকানে, মসজিদে ও শিক্ষাপ্রতিষ্টানে কেউ বসে না। এমনি এক মানবেতর জীবন-যাপন করছে তারা।
এদিকে আক্রান্তদের চিকিৎসার্থে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি সাহায্য সংস্থা মেডিসিন সেন্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) কমিউনিকেশন। তবে তা অপ্রতুল। ক্যাম্প থেকে পাশের গ্রামগুলোতে এ চর্মরোগ এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লেও এটা মহামারী বা বিপদজ্জনক রোগ হিসেবে মানতে নারাজ কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান।
সরেজমিন গিয়ে কথা হয় হাকিমপাড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ফোরকান, আয়েশা বিবি, নুরুল আমিনসহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে। তারা জানান, ক্যাম্পে এমন কোন পরিবার পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে যে পরিবার এই রোগে আক্রান্ত নয়। পরিবারের সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। ওষুধ খেলে কিছুদিন ভালো থাকে, এরপর আবারও শুরু হয় চুলকানি।
ক্যাম্পগুলোতে, ২০ জন পর্যন্ত লোক একটি টয়লেট ভাগ করে, সেখানে তারা একে অপরের সাবান ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া একটি টিউবওয়েল থেকে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জন একত্রে খাবার পানি সংগ্রহ করে। এমন ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবাসের ফলে এই রোগ দ্রুত ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে বলে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
হাকিমপাড়া ১৪ নাম্বার ক্যাম্পের এ ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ শরীফ জানান, তার তিন বছরের মেয়ে মুনতাহারা। গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে এক ধরণের চর্মরোগে আক্রান্ত সে। চুলকানির যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে পার হয় তার পুরো সময়। মোহাম্মদ শরীফের দাবী, শুধু মুনতাহারা নয়, তার পরিবারের ৬ সদস্যের মধ্যে আরো ৪ জন এই রোগে আক্রান্ত।
১৪ নাম্বার হাকিমপাড়া ক্যাম্পের এ ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ জুবায়ের পরিবারে গিয়ে দেখা যায়, কিভাবে মাত্র ছোট দুটি কক্ষে ৬ জন মিলে বসবাস করেন। এই ২ কক্ষেই রান্নাবান্নাও সারতে হয় তাদের৷ এমন পরিস্থিতিতে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যকে আলাদা রাখার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি। জুবায়েরের মতো পরিস্থিতি ক্যাম্পের প্রায় সব রোহিঙ্গার। বর্তমানে তার মেয়ে সুহানা ও স্ত্রী সানজিদা স্ক্যাবিসে আক্রান্ত বলে জানান জুবায়ের। একই ক্যাম্পের বাসিন্দা মৌলভী হানিফ ও আলতাজ জানান, ক্ষুদ্র পরিসরে অনেক মানুষের বসবাসের পাশাপাশি অপর্যাপ্ত পানি এবং স্যানিটেশনের কারণে ক্যাম্পে এ রোগের প্রার্দুভাব বাড়ছে।
তবে এটিকে স্ক্যাবিস রোগ বলে নিশ্চিত করেছেন ক্যাম্পের চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত ডা. কামার উদ্দিন। তিনি জানান, সাধারণত বিছানা ভাগাভাগি ও একই কাপড় মানুষ ব্যবহার করলে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগের প্রধান উপসর্গ চুলকানি। চুলকানির কারণে ক্ষত হতে পারে এবং দ্রুত চিকিৎসা না পেলে কিডনি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে এতে। তাই দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
রোহিঙ্গা নারী রোকেয়া বেগম (২৪) এর দেড় বছরের শিশুও চুলকানির এই রোগে আক্রান্ত। তিনি জানান, চুলকানির কারণে তার সন্তান খাবার খেতে পারে না, ঘুমোতে পারে না। সারাক্ষণ কেঁদে কেঁদে থাকে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়া এই রোগের নাম স্ক্যাবিস। স্ক্যাবিস একধরনের ছোঁয়াচে চর্মরোগ, সাধারণ লোক যাকে খোসপাঁচড়া বলে থাকেন। ত্বকে বাসা বাঁধে এমন একধরনের কীটের কারণে এটি হয়ে থাকে। এটি ত্বকের মধ্যে বাসা বাঁধে এবং এবং ডিম পাড়ে।
১৪ নং হাকিমপাড়া ক্যাম্পে অবস্থিত এমএসএফের একটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশ রোগীই স্ক্যাবিসে আক্রান্ত। এমএসএফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র গত ১৪ মার্চ থেকে ১৪ এবং ১৫ ক্যাম্পে এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৩৬ হাজার স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোহিঙ্গা। এছাড়াও অন্যান্য ক্যাম্পের হেলথ সেন্টারগুলোতেও কয়েক হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে এমএসএফ। এরমধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যা বেশি।
স্ক্যাবিসের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় এমএসএফ কমিউনিকেশনে কাছে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্ক্যাবিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা গত তিন বছরের মধ্যে এবছর সবচেয়ে বেশি দেখেছে সংস্থাটি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে গড়ে ৪৩ হাজার চর্মরোগের রোগীর চিকিৎসা করেছে সংস্থাটি। ২০২১ সালে চর্মরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৭৩ হাজারে পৌঁছে যায়। চলতি বছরের ১৪ মার্চ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত স্ক্যাবিস সংক্রমণ গণনা শুরু করে তারা। এই সময়ে তারা হাকিমপাড়া ও জামতলী হেলথ সেন্টারে ৩৬ হাজার স্ক্যাবিস রোগীর চিকিৎসা করেছে। এছাড়াও ক্যাম্প ৮ ডব্লিউ এবং গোয়ালমারা হেলথ সেন্টারে ৪ হাজার ২০০ জন স্ক্যাবিস রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে। পাশাপাশি কুতুপালং, বালুকালি এবং উচিপ্রাং-এ আরও অনেক স্ক্যাবিস রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে এমএসএফ।
মেডিসিন সেন্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) এর মেডিকেল অ্যাক্টিভিটি ম্যানেজার ডা. কামার উদ্দিন জানান, চলতি বছরের শুরুর দিকে স্ক্যাবিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকন্দ্রের মধ্যে একটি অস্থায়ী স্ক্যাবিস ট্রিটমেন্ট সেন্টার চালু করেছে। যেখানে আক্রান্তদের আলাদা করে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।। স্ক্যাবিস পরিস্থিতি দিনদিন অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে দাবী এই জরুরী মানবিক সহায়তা প্রদানকারী চিকিৎসা সংস্থাটির।
এপ্রিলের গোড়ার দিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে স্ক্যাবিস সংক্রমণের একটি মূল্যায়নের জন্য স্বাস্থ্য অংশীদারদের নিয়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। জরিপটি স্ক্যাবিস নিয়ে উদ্বেগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রাথমিক ফলাফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গড়ে ১০.২ শতাংশ প্রাদুর্ভাবের হার পায়। অর্থাৎ ক্যাম্পে ১০.২ শতাংশ রোহিঙ্গা স্ক্যাবিসে আক্রান্ত। যা স্বাস্থ্যখাতের জন্য সংক্রমণ থ্রেশহোল্ড অতিক্রম করে। স্ক্যাবিস ধীরে ধীরে মহামারী আকার ধারণ করতে যাচ্ছে বলে ইঙ্গিত করা হচ্ছে সেই রিপোর্টে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্পে মিয়ানমারে নির্যাতিত ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করে। আশ্রয় শিবিরের ছোট্টো ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারকে।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘেঁষা এলাকার জনপ্রতিনিধি মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। তিনি জানান, শুধু রোহিঙ্গা নয়, ক্যাম্পের আশপাশের স্থানীয়রাও স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ উদ্বীগ্ন। দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবী তার।
ক্যাম্পে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি হলেও কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলছেন, স্ক্যাবিস এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। এটি নিয়ে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই জানিয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়োজিত স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা তাকে এখন পর্যন্ত বিষয়টি মহামারী পর্যায়ের যাওয়ার ব্যাপারে কোন ধরনের তথ্য দেননি। ২০২০ এবং ২০২১ সালের দিকে চর্মরোগের উপস্থিতি বেশ দেখা গেলেও চলতি বছর স্ক্যাবিস জাতীয় চর্মরোগ হঠাৎ বেড়ে গেছে। এখনই স্বাস্থ্যবিভাগ সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে স্ক্যাবিস মহামারী আকার ধারণ করলে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে দাবী সচেতন মহলের।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-