কক্সবাজার জার্নাল ডেস্ক •
নামিরা বড় হয়েছেন সৌদি আরবে। তারপর ২০১৪ সালে এ-লেভেল পড়াশোনা সম্পন্ন করতে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে। নামিরা বলেন, আমি পাকিস্তানি পরিবারের সন্তান। বেড়ে উঠতে হয়েছে প্রচণ্ড কঠোর নিয়মকানুনের মধ্যদিয়ে। এই সমাজে নারী এবং পুরুষকে সব সময়ই আলাদা করে রাখা হয়। একা একা বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। বাইরে যেতে হলে বাবা বা কোনো এক ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হতো। অনলাইন গার্ডিয়ান লিখেছে- কিন্তু একবার মালয়েশিয়ায় পা রাখার পর তার চোখ খুলে যায়। তিনি দেখতে পান নতুন এক পৃথিবী। যেখানে কোনো বাধা নেই।
অবাধ মুক্ত এক পৃথিবী তার সামনে। নামিরা বলেন, মালয়েশিয়ায় আমি পেলাম আমার স্বাধীনতা। অবাধে বন্ধু বানানোতে ছিল না কোনো বাধা। ইচ্ছেমতো জিনিসপত্র কিনতে মুদি দোকানে যেতে পারি। চড়তে পারি ট্রেনে। প্রথমবার এভাবেই আমি একা হয়েছি।
নামিরা যাদের সঙ্গে মালয়েশিয়ার বাড়িতে থাকতেন তাদের মাধ্যমে ২০১৪ সালের অক্টোবরে ফারহান নামের এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। নামিরা দেখতে পান, ফারহানের বাড়ি বাংলাদেশে। তিনিও একই কলেজে পড়াশোনা করেন। ব্যাপারটা খুবই চমৎকার। তবে প্রথম দেখাতেই তাদের মধ্যে কোনো প্রেম জমে ওঠেনি। পরের কয়েক সপ্তাহে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। নিয়মিত গ্রুপের সঙ্গে তারা এখানে ওখানে ঘুরতে থাকেন। পরের বছরের জানুয়ারিতে শীতকালীন ছুটিতে দেশে ফেরেন ফারহান।
কিন্তু নামিরা বলেন, সব সময়ের জন্য আমরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতাম। আমাদের জীবন, ভবিষ্যৎ, সবকিছু নিয়ে কথা বলতাম। ওর সঙ্গে কথা বলে যে স্বস্তি পেতাম, তা অন্য কারও সঙ্গে কথা বলে পেতাম না। আস্তে আস্তে নামিরার সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করে তোলেন ফারহান। বলেন, আমি যখন মালয়েশিয়া যাই। সেখানেই নামিরার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে চাইনি। কিন্তু তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর আমার ধারণা পাল্টে গেল।
নামিরা যেন একটি পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ। তার মধ্যে সবকিছু আছে। তাদের মধ্যে কথা হতে থাকে নামিরা যে কঠোর পরিবেশে বড় হয়েছেন তা নিয়ে। তাদের সাংস্কৃতিক পার্থক্য নিয়ে। নামিরা বলেন, ফারহান অধিক উদার ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে। আমাকে সে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফারহানের ওপর আস্থা বাড়তে থাকে নামিরার। এপ্রিলের এক রাতে মনের মধ্যে কি যেন ঘটে যায়। নামিরাকে বেষ্টন করে ফারহানের হাত।
তিনি বলতে চান, আরও বেশি কিছু পাওয়ার জন্য তিনি আগ্রহী। নামিরা বলেন, আসলে আমি সব সংকেত বুঝতে পারিনি। তা সত্ত্বেও আমি বাস্তবে সুখী। এর অল্প সময় পরেই তারা যুগল হয়ে ওঠেন। ওই গ্রীষ্মেই তারা দু’জনে ছুটি কাটাতে তাদের বাড়ি ফেরেন। নামিরা বলেন, পড়াশোনায় আমি খুব খারাপ করছিলাম। কারণ, আমি ভালো পারি না এমন একটি বিষয় নিয়েছি। এতে আমার পিতামাতা রেগে গেলেন।
তারা আমার ফোন এবং ল্যাপটপ নিয়ে নিলেন। আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করলেন। এমন অবস্থায় ফারহানের সঙ্গে কথা বলতে পাগলের মতো হয়ে যেতেন নামিরা। ভাই বা বোনের ফোন নিয়ে রাতে ফারহানকে ফেসবুকে মেসেজ দিতেন।
ফারহান বলেন, দু’তিন দিন পরে মাত্র একটি মেসেজ পেতাম তখন। আমাদের দু’জনের জন্যই বিষয়টি ছিল খুব কঠিন। আমার আশা ছিল, নামিরা একদিন ফিরবেই। এরই মধ্যে নামিরার পিতামাতা তাকে রিয়াদে পড়াশোনা করতে দিতে রাজি হলেন। ফলে আবার ল্যাপটপ হাতে এলো নামিরার। তিনি বলেন, কিন্তু আমার মনপ্রাণ পড়ে আছে মালয়েশিয়ায়। সেখানে ফিরে যাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করি।
অবশেষে তার পিতামাতা হাল ছেড়ে দিলেন। ২০১৬ সালের অক্টোবরে আবার মালয়েশিয়া ফেরেন নামিরা। তাকে কাছে পেয়ে ফারহান বলেন, এত দীর্ঘ সময় পর পুনরায় একত্রিত হতে পেরে আনন্দে বুক ফেটে যাচ্ছিল। এমনি করে হাসি আনন্দে তাদের কেটে যায় এক বছর। আবার কেন যেন বিচ্ছেদের সুর বেজে ওঠে।
নামিরাকে আবার দেশে ফিরতে হবে। তিনি বলেন, আমি জানতাম পরিবার চাইছে ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারিজে’ আমাকে রাজি করাতে। কিন্তু আমি তো এই ধারণা কখনো মেনে নেবো না। আমার জীবন সম্বন্ধে সবচেয়ে ক্রেজি এক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্লাইট মিস করলাম। এরপরই এই যুগল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন কুয়ালালামপুরেই বিয়ে করে ফেলবেন। বিয়ে করেও নেন। এরপর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তিনি। কারণ, তিনি জানেন পরিবারের প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ।
নামিরা বলেন, আমি জানি তারা কখনো এই বিয়ে মেনে নেবে না। কয়েকদিন পরে তাদেরকে আমি জানালাম- আমি ভালো আছি। আরও বললাম- আমি বিয়ে করে নিয়েছি। তাদেরকে বললাম আমার জীবন আমি বেছে নিয়েছি। কিন্তু তার এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি পরিবার। তবু নামিরা এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের। ওদিকে এত তাড়াতাড়ি তারা বিয়ে করে ফেলবেন এটা জেনে ফারহানের পরিবার হতাশ হয়ে পড়ে। তবে তারা নামিরাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
২০১৯ সালে এই যুগল ঢাকা আসেন। বর্তমানে এখানেই তাদের দুটি বিড়ালসহ বসবাস করছেন। নামিরা একজন ফ্রিল্যান্স লেখক। অন্যদিকে ফারহান তার পিতার কৃষি বিষয়ক ব্যবসা দেখাশোনা করেন। ফারহান বলেন, আমাদের দু’জনের মধ্যে অনেক মিল আছে। কিন্তু আমার মধ্যে নেই, এমন অনেক গুণ আছে নামিরার। সে খুব ঠাণ্ডা মাথার। নামিরা স্বীকার করেন তারা একজন অন্যজনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেন। ফারহানকে তিনি চমকপ্রদ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি মানুষের মন বুঝতে পারেন। ফারহান ক্রিয়েটিভ। আমি তাকে নিয়ে একসঙ্গে খুব সুখে আছি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-