বঙ্গোপসাগর ও বাঁকখালী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে কক্সবাজার শহর। আর শহরটিকে রক্ষায় প্রাকৃতিকভাবেই (কিছু সৃজিত) একদিকে ঝাউবন অন্যদিকে প্যারাবন বেষ্টন করে আছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কক্সবাজারের মানুষ বাঁকখালী নদী ও প্যারাবন রক্ষায় সম্মিলিতভাবে কোন আওয়াজ তুলতে পারেনি বা তুলেনি অথবা এর কোন প্রয়োজনই অনুভব করেনি (বিচ্ছিন্নভাবে হাতেগোনা কয়েকজন পরিবেশবাদী ব্যতীত)।
যার কারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে চুপ থাকতে পেরেছে। ফলাফল হিসেবে জেলা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট থেকে পেশকার পাড়া পর্যন্ত এক কিলোমিটার এলাকায় প্যারাবনের লাখ লাখ গাছ কেটে, প্রকাশ্যে জোয়ার-ভাটা বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে, পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে গত এক বছরে আনুমানিক ১০০ একর জমি বিনা বাধায় দখল করেছে দখলদাররা। শুধু দখল করে বসে থাকেনি, নদী থেকে নীতিমালা অনুসরণ না করে বালি উত্তোলনের মাধ্যমে জলাশয় ও নদী ভরাট করে সেখানে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই সেখানে খুঁটি স্থাপন করে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ‘মিনি টাউন’ গড়ে তোলা হয়েছে।
প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে নগর গড়ে উঠার পর যখন সেখানে জমি নিয়ে দুই দখলদার পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিল ঠিক তখনই আমাদের প্রশাসন যন্ত্র গাড়ি বহর নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে উত্তেজনা প্রশমনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। একই সাথে জেলা আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠকে আলোচনা হলো, বাঁকখালী দখল উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হলো। গত রবিবার (১২ জুন) অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে গিয়ে উচ্ছেদ না করে দখলদারদের কাগজপত্র নিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। এটি নিয়ে জনমনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো- প্রশাসন কি দখলদারদের জমি পরিমাপ করে দখল বুঝিয়ে দেয়ার কাজে নেমেছেন? নাকি আসলেই বাঁকখালী দখলমুক্ত করবেন। আমার মনে হয় না, প্রশাসন দখল উচ্ছেদ করতে পারবে বরং তারা সেখানে দখলদারদের প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে আসবেন। যেখানে গত এক বছরে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন (পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যতিত) দখলদারদের দখলে কোন বাধা দেয়নি সেখানে এখন কিভাবে এটি উচ্ছেদ করবেন তা আমার বুঝে আসে না। বাঁকখালী নদী দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০২০ সালের ১৫ মার্চ ও ২০২১ সালের ৭ মার্চ দুই দফায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসক সহ ১১ জন সরকারি কর্মকর্তাকে চিঠি দেয় পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’। এর ভিত্তিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকেও ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়।
প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ, মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করার পর ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেয়া হয়। স্মারকলিপির মাধ্যমে বাঁকখালী নদী রক্ষায় ১৩ দফা দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন তা আমলে নিয়েছে বলে মনে হয়নি। ওই দিন বাঁকখালী নদী দখল সংক্রান্ত বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ মামুনুর রশীদ এর সাথে আমি সরাসরি কথা বলেছি। তিনি নির্দেশও দিয়েছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বাঁকখালী নদী দখলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে আমাদের প্রশাসন বাঁকখালী নদী রক্ষায় আন্তরিক নয়। খুব সচেতনভাবেই তাঁরা বাঁকখালী নদী দখল সংক্রান্ত বিষয় এড়িয়ে চলেন, ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্ব অবহেলা করেন।
প্রশাসন কেন প্রশ্নবিদ্ধ-
১) কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাটে কক্সবাজার মৌজার বিএস ১ নং খাস খতিয়ানের বিএস ২২৬২ দাগে নদী শ্রেনীর ৫৪ একর ০৪ শতক, ২২৬২/২২৭০ দাগে খাল শ্রেণির ১ একর ৬৬ শতক, ১০০০১ দাগে বালুচর শ্রেণির ১ একর ৫১ শতক, ১০০০২ দাগে নদী শ্রেণির ৬৬ একর ৪০ শতক এবং ১০০০৩ দাগে বালুচর শ্রেণির ২২ একর ৯০ শতক জমির অধিকাংশ প্রকাশ্যে দখল, প্যারাবন ধ্বংস করে ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে (গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি)। বার বার প্রশাসনকে অবহিত করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকারি নদীর জমিতে আনুমানিক ২০০ প্লট করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে প্রকাশ্যে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পমুলে বেচা-কেনা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। পাকা-আধাপাকা, দালানকোটা গড়ে উঠছে নির্বিঘ্নে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অবহিত করা হলেও বরাবরের মতোই তাঁরা চুপ থেকেছে। ফলশ্রুতিতে সেখানে গড়ে উঠেছে নগর। ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসন চুপ থাকায় অসাধুরা নির্বিঘ্নে দখল পাকাপোক্ত করেছে। দখলদারদের আদালতের আশ্রয় নেয়ার ক্ষেত্রও তৈরি করে দেয়া হয়েছে।
২) প্রকৃতির নিয়মে স্বাভাবিকভাবেই নদী নদীর স্থানে পুরোপুরি নেই। সেই হিসাবে কস্তুরাঘাটের পূর্ব ও পশ্চিমে এক কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় নদী বর্তমানে খুরুশকুল মৌজার ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া খুরুশকুল মৌজার অন্তত ২০ টি দাগের ৫০ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে নদী, নদীর জোয়ার-ভাটা, জলাশয়, প্রাকৃতিক প্যারাবন, পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সৃজিত প্যারাবন, নদীর সংযোগ ছড়া বিদ্যমান। সেখানে এসব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে জমির শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত করা বা গতিপথ পরিবর্তন করার আইনগত কোন সুযোগ নেই।
এছাড়া এটি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)। কিন্তু আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ওইসব দাগে জমি বিক্রির অনুমতি, রেজিষ্ট্রেশন ও খতিয়ান সৃজন করে দিচ্ছেন। এমনকি জমি মালিকদের মধ্যে কোন বিরোধের সূত্র ধরে এমআর মামলা, দেওয়ানীমামলার উদ্ভব হলে প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা বাদি বা বিবাদীর পক্ষে ওই জমিতে দখলে আছে মর্মে প্রতিবেদন দেন। অথচ বাস্তবে ওই জমিতে নদীর জোয়ার-ভাটা ও প্যারাবন থাকায় দখলে থাকার সুযোগ নেই। আর দখলদাররা প্রশাসনের এসব সুযোগ নিয়ে বীরদর্পে নদীর জোয়ার-ভাটা বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে, জলাশয় ভরাট করে, প্যারাবন কেটে জমি দখল করছে। প্রকাশ্যে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে রাতারাতি ওই জমির শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে দখলদাররা আদালতের আশ্রয় নিচ্ছে। এ অবস্থায় প্রশাসন বাঁকখালী নদী দখলমুক্ত করার যতই হাঁকডাক করুক না কেন, সেই ‘সাবেক বাঁকখালী নদী’তে গিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো বা দখল হওয়া জমি ফিরিয়ে আনার নৈতিক শক্তি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নেই।
৩) বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ ও ১৯৯৭; মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল প্রকার পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০; বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০০০; বাংলাদেশ পানি আইন,২০১৩; জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২; ইমারত নির্মাণ আইন, ইসিএ সহ বিভিন্ন আইন ও বিধিমালা অনুসারে- নদীর জোয়ার-ভাটা বন্ধে দেয়া বাঁধ অপসারণ, প্যারাবন নিধন বন্ধ, বালি উত্তোলন করে নদী কেন্দ্রিক বিভিন্ন ছড়া ভরাট বন্ধ, জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং অপসারণের ক্ষমতা প্রশাসনের রয়েছে। কিন্তু (অনেক চাপাচাপির পর পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়ের করা দুটি মামলা ছাড়া) জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ভূমি প্রশাসন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অথচ আইন অনুসরণ করে আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে বাঁকখালী নদীর আজকের এই অবস্থা আমাদের দেখতে হতো না।
৪) বছরের পর বছর ধরে দেখে আসছি, বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদের দাবি তোলা হলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাজেট না থাকার অজুহাত দেওয়া হয়। আসলে কি তাই? বাজেট না থাকলে বড় আকারের উচ্ছেদ অভিযান চালানো যায় না সত্য কিন্তু অবৈধ দখলও কি ঠেকানো যায় না? অবৈধ দখলে বাধা না দেওয়ায় গত এক বছরে ১০০ একর জমি দখল হয়ে গেছে। আর বাজেট না থাকার অজুহাতে বরাবরের মতো তা কখনো উচ্ছেদ হবে না। ফলশ্রুতিতে দেখা যাবে একসময় উন্নয়নের নামে সরকারি বরাদ্দ দিয়েই সেখানে রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে, সেই দিন আর বেশি দূরে নয়।
যাই হোক অনেক হতাশার মাঝেও আশার কথা হলো প্রশাসন অন্তত বাঁকখালী নদীর বাস্তব চিত্র দেখে এসেছে, দখলমুক্ত করার কথা বলেছে। আমরা আশাবাদী প্রশাসন এবার হলেও সক্রিয় হবে, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রশাসনকে এক্ষেত্রে সহযোগিতা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য। কক্সবাজারের সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন পেশাজীবি, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ক্রীড়া-রাজনৈতিক সংগঠন, সর্বস্তরের সচেতন মহল ও কক্সবাজারবাসীর এখনও সময় আছে বাঁকখালী নদী রক্ষায় সোচ্চার হওয়ার। সম্মিলিতভাবে সবাই এগিয়ে না আসলে বাঁকখালী নদী রক্ষা সম্ভব নয়। আসুন বাঁকখালী নদী রক্ষায় আমরা একযোগে আওয়াজ তুলি, প্রকৃতির ঐকতানে টেকসই জীবন গড়ি।
রাশেদুল মজিদ, গণমাধ্যম ও পরিবেশকর্মী
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-