কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে আটক এসব রোহিঙ্গা শিশুদের কারও মা নেই,কারও বাবা নেই। কিন্তু শরনার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া চার শতাধিক রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী ও নারী গত ৪মে তারা হঠাত কেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে চলে আসল। জানা যায়,প্রতিটি ক্যাম্পের প্রবেশমুখে এপিবিএন পুলিশের তল্লাশি চৌকি। এসব তল্লাশি চৌকি অতিক্রম করে কিভাবে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র বেরিয়ে আসল? তা এখন জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সাড়ে ৪’শ রোহিঙ্গা আটক কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে
জানা যায়,যেসব রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী ও নারী-পুরুষকে আটক ও পরে ক্যাম্পে ফেরত দেয়া হয়েছে, তারা কখনও সৈকত দেখেনি। দেখার আগ্রহও তাদের নেই। তবে কেন এত রোহিঙ্গা সৈকতে? এসব রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী ও নারীদের জমায়েত করার নেপথ্যে বহু তথ্য মিলছে। আর এই প্রশ্নের জবাব কয়েকজন আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপের নেতার কাছে মিলবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। সৈকতে রোহিঙ্গা জমায়েতকে নতুন ছক বলে ধারণা করেছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র জানায়, আবদ্ধ কোন মিলনায়তন বা বাসায় জমায়েত হলে প্রশাসনের নজরে পড়তে পারে ধারণায় খোলা আকাশের নিচে পর্যটকের ছদ্মাবরণে এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা হয় সমুদ্র সৈকতে। আরাকান বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের একাধিক সংগঠনের পক্ষে প্রত্যেককে নগদ এক হাজার টাকা করে অনুদান দেয়ার কথা ছিল।
খবর পেয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশ এই রোহিঙ্গাদের আটক করে পরবর্তীতে কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছে।আর কক্সবাজার সৈকতে রোহিঙ্গাদের আটকের খবর পেয়ে একই দিন তৎক্ষণাত ইনানী সৈকত থেকে সটকে পড়ে রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দলটি।
সূত্র জানায়, ইতিপূর্বে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ত্যাগ করলেও সংখ্যায় ছিল কম। তাও এভাবে প্রকাশ্যে নয়। আটক রোহিঙ্গা ছাত্ররা ক্যাম্প ত্যাগ করতে কক্সবাজারে আসেনি। তাদের এক হাজার টাকা হারে প্রদানের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশে স্থায়ী হতে ইউএনএইচসিআরের কার্যালয়ের সম্মুখে মানববন্ধন করতে নিয়ে আসা হয়।
আটক রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশিরভাগই ক্যাম্পে স্থাপিত একাধিক মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং কিছু এতিম শিশুর মা-বোন।তাদের সহজে ক্যাম্প থেকে বের হতে চেকপোস্টকে আগেই ম্যানেজ করেছে পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা।
সূত্র জানায়,মিয়ানমার শীঘ্রই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রাজি হয়েছে, ঠিক এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে একটি অরাজকতা সৃষ্টিকল্পে কয়েকটি এনজিও, পুরনো রোহিঙ্গা গ্রুপ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। রোহিঙ্গা শিবিরের দায়িত্বে যখন সেনা বাহিনীর সদস্যরা ছিল, তখন দলবদ্ধভাবে রোহিঙ্গারা বের হতে পারেনি। কয়েকজন বের হলেও উখিয়া কলেজ গেট স্থানে স্থাপিত চেকপোস্টে সেনা সদস্যরা নামিয়ে নিয়েছে ওই রোহিঙ্গাদের।
কিন্তু মাস দেড়েক আগে উখিয়া ডিগ্রী কলেজ সংলগ্ন সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিটি তুলে দেয়ার পর রোহিঙ্গারা দায়িত্বরত আর্মড পুলিশের কতিপয় অসৎ সদস্যকে ম্যানেজ করে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্প থেকে। এরপর থেকে ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএন পুলিশ ফোর্সের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে। আর্মড পুলিশের কতিপয় সদস্য ক্যাম্পে তথ্য সংগ্রহের জন্য সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয়না।
অথচ নগদ টাকায় রোহিঙ্গাদের প্রকাশ্যে দোকানপাট, ব্যবসা বাণিজ্য ও বাইরে যাওয়া আসা করার সুযোগ দিচ্ছে। প্রতিটি ক্যাম্পের প্রবেশমুখে এপিবিএন পুলিশের তল্লাশি চৌকি অতিক্রম করে কিভাবে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র বেরিয়ে আসল? তা এখন জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গত ৪মে বিকেলে কক্সবাজার সৈকতে আটক হওয়া টেকনাফ নয়াপড়ার এক মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলের পিতা হাফেজ আবু বকর বলেন, চলতি বছরের ২৫ আগস্ট নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের ৫ বছর পূর্ণ হবে। নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এরকম ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে রিফ্রেশমেন্টের সুযোগ পায়নি কখনও। গুটিকয়েক রোহিঙ্গা নেতা প্রলোভন দেখিয়ে আমার দুই ছেলেকে সকালে নিয়ে যায়। জনপ্রতি ১০০০ টাকা প্রদান করা হবে এমন তথ্যের ভিত্তিতে মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্ররা দল বেঁধে মেরিন ড্রাইভ রোড হয়ে নয়াপাড়া মারকায ওমর ও বাহারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে ৮০ জন ছাত্র কক্সবাজার যায়।
সূত্র আরও জানায়. প্রথমত প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিতে টালবাহানা শুরু করতেই মানববন্ধন করা এবং মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে শরণার্থীর পূর্ণ অধিকার দেয়া। কক্সবাজারের লিংকরোড ও রামু উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত অন্তত ১২জন রোহিঙ্গা নেতার পরিচালনাধীন মাদ্রাসাগুলোতে রোহিঙ্গা ছাত্রদের বিনামূল্যে পড়ানো হয়। ওই ছাত্রদের লেখাপড়ার পাশাপাশি আনন্দ বিনোদন ও এতিমদের টাকা প্রদানের জন্য পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা একত্রে নিয়ে আসে।
অভিযোগ উঠেছে, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর আইন-শৃংখলার দেখভাল করার জন্য আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপিবিএন) এর ৪টি ব্যাটালিয়ানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারপরেও এভাবে রোহিঙ্গারা ফ্রি স্টাইলে শিবির থেকে কিভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান জানান,কক্সবাজার সৈকতে আটক হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিবির থেকে আসা বিপুল সংখ্যক মাদরাসায় পড়ুয়া আলখেল্লা পরিহিত রোহিঙ্গাও রয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা সন্দেহও দেখা দিয়েছে।তিনি আরো জানান, মাত্র কয়েক ঘণ্টার অভিযানে যদি এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আটক হয়ে থাকে তাহলে পুরো কক্সবাজার জেলা শহরে কত হাজার আর কত লাখ রোহিঙ্গায় ভরে গেছে। এনিয়ে আমরা আতংকের মধ্যে রয়েছি।
এ ব্যাপারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদৌজ্জা বলেন, সৈকতসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক ৪৫৩ রোহিঙ্গাকে রাতেই একাধিক যানবাহনে করে উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে ক্যাম্প থেকে কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী যেন বাইরে যেতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর রাখা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সরকার উখিয়া ও টেকনাফে নির্ধারিত স্থানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের খাওয়া-দাওয়াসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের শিবিরের বাইরে যাবার কোনো সুযোগ নেই।তিনি আরও জানান, শিবির ছেড়ে শত শত রোহিঙ্গা কক্সবাজারের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি ঘটছে।
মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ বলেন,আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে আসার নিয়ম নেই। তারপরও রোহিঙ্গারা নানা পথে বেরিয়ে আসছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়ছেন। রোহিঙ্গারা যেন ক্যাম্পের বাইরে আসতে না পারেন, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-