অনলাইন ডেস্ক •
হাসপাতালের বিছানায় অপরিচিত মুখ দেখলেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ছোট্ট তানভীরুল। কখনও কান্না জুড়ে দেয়। ছোট্ট শরীরের ওপর দিয়ে বড় একটা ধকল গেছে, তা ওর মুখমণ্ডলই বলে দিচ্ছিল। গত শনিবার বিকেলে রাজধানীর সবুজবাগে ১০ মাস বয়সী এই শিশুটির চোখের সামনে বাসার ভেতর নির্মমভাবে খুন করা হয় মা তানিয়া আক্তার মুক্তাকে (২৬)।
পুলিশ বলছে, লুটপাট চালাতে বাসায় যায় ওই দুর্বৃত্ত। এয়ারকন্ডিশন (এসি) মেরামতের কথা বলে মো. বাপ্পী নামের ওই দুর্বৃত্ত সেখানে যায়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সে এসি মেরামতের জন্য গিয়েছিল। খালি বাসা পেয়ে তানিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করে দুই ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যায়।
খুনের সময়ে তানভীরের হাত-পা, মুখ আটকে দেওয়া হয় স্কচটেপে, মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছিল বালিশে। তানিয়ার পৌনে তিন বছরের মেয়ে মায়মুনা জামানকেও একইভাবে বাঁধা হয়েছিল। এরপর শিশু দুটিকে ফেলে রাখা হয় মায়ের রক্তাক্ত লাশের পাশে। শনিবারের ওই নির্মমতার পর মায়ের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হলেও শিশু দুটিকে নেওয়া হয় মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে মায়মুনাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলেও তানভীর হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন।
গতকাল রোববার দুপুরে মুগদা হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সন্তানের চিকিৎসা নিতে আসা অন্য মায়েদের জটলা ছোট্ট তানভীরকে ঘিরে। দুধের তৃষ্ণায় ছোট্ট শিশুটি কান্না করতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন অন্য মায়েরা। এক মা তাকে আপন সন্তানের মমতায় বুকে তুলে নিয়ে দুধপান করাচ্ছিলেন। তখন শিশুটির কান্না থামে। তানভীরের বাবা মাইনুল ইসলাম আর অন্য স্বজনরা মায়ের লাশ আর থানা পুলিশ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করায় হাসপাতালে আসতে পারেননি। খবর পেয়ে গতকাল সকালে গ্রাম থেকে দাদি জোসনা বেগম হাসপাতালে এলেও তিনি পরিবেশটা যেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এজন্য অন্য মায়েরাই শিশুটির আপন হয়ে উঠছেন।
একই ওয়ার্ডে জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে রাজধানীর দোলাইরপাড়ের বাসিন্দা আকবর চৌধুরী ও নাদিয়া ইসলাম দম্পতির ১১ মাস বয়সী সাইফা তাসফি রোজা। হাসপাতালের শয্যায় রোজার মা তানভীরকে কোলে নিয়ে দুধপান করাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, ওই শিশুটির সঙ্গে শনিবার প্রায় একই সময়ে তার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন। ঘটনা শুনে তিনি খুব কষ্ট পান। এরপর নিজের সন্তানের সঙ্গে মা-হারা তানভীরের দেখভাল শুরু করেন। নিজের সন্তানের সঙ্গে তিনি মা-হারা তানভীরকে খাবার ভাগ করে দিচ্ছেন। এতে তার স্বামীও খুশি।
আকবর চৌধুরী বলেন, তার স্ত্রীর এমন সিদ্ধান্তে অন্য একটি নিষ্পাপ শিশু বেঁচে যাচ্ছে, এটা তার জন্য অনেক সম্মানের।
শিশু ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসক জানান, বালিশচাপা দেওয়ায় তানভীরের শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল। শিশুটিকে হাসপাতালে আনার পর অন্তত তিন ঘণ্টা তাকে অক্সিজেন দিতে হয়েছে।
সবুজবাগ থানার ওসি মুরাদুল ইসলাম জানান, প্রাথমিকভাবে তারা জেনেছেন বাসা থেকে মাত্র দুই ভরি স্বর্ণালংকার খোয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই স্বর্ণালংকার লুট করার সময়ে বাধা পেয়ে তানিয়াকে খুন করা হয়। হয়তো দুই শিশু কান্নাকাটি করায় ওদের হাত-পা ও মুখ বাঁধা হয়েছিল। দুর্বৃত্তকে গ্রেপ্তারের পর বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসবে। ওই ঘটনায় মামলা হয়েছে।
স্বজনরা জানান, হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় তানিয়া ও তার শিশু দুই সন্তান ছিল। স্বামী মাইনুল ইসলাম ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টেকনিশিয়ান হিসেবে দায়িত্বরত। খবর পেয়ে শনিবার রাতে তিনি ঢাকায় ফেরেন।
মাইনুল ইসলাম বলেন, বাপ্পী বিভিন্ন সময়ে তার বাসায় এসি মেরামত করে। শনিবার দুপুরেও সে তানিয়াকে ফোন দিয়ে এসি যাচাইয়ের জন্য বাসায় আসতে চায়। তখন তাকে বিকেলে আসতে বলা হয়। ওই ছেলেটাই তার স্ত্রীকে খুন করে পালিয়েছে।
গতকাল সবুজবাগের দক্ষিণগাঁও মাস্টার গলির ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এলাকাটি প্রায় নিরিবিলি। ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় বাড়ি রয়েছে। কোথাও কোথাও নতুন বাড়ি নির্মাণ চলছে। তানিয়া ওই এলাকারই তিনতলা একটি বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন। বাড়িটির নিচে মূল ফটক তালাবদ্ধ। ডাকাডাকির পর বাড়ির মালিকের ছেলে মাহিম আহমেদ বেরিয়ে এলেও তালা খুলতে রাজি হননি।
ভেতর থেকেই তিনি বলেন, শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তানিয়ার মেয়ে মায়মুনা রুমের বাইরে এসে সিঁড়ির পাশে কাঁদছিল।
তিনি বাসা থেকে বেরিয়েই দেখেন, শিশুটির পায়ে, শরীরে ও হাতে তখনও স্কচটেপ মোড়ানো। ওদের বাসার ভেতর যেতেই নির্মম দৃশ্য দেখে তিনিও চিৎকার করে ওঠেন। ছোট্ট তানভীর তখনও মায়ের লাশের পাশে শোয়া, স্কচটেপে শরীর মোড়ানো আর মুখের ওপর বালিশ দেওয়া। এসির যন্ত্রপাতি পুরো বাসায় ছড়ানো। তিনি বলেন, তাদের বাসার গেট সব সময় তালাবদ্ধ থাকায় ভাড়াটিয়াদের কাছে চাবি থাকে। দোতলার ভাড়াটিয়া তানিয়া অনুমতি দেওয়াতেই হয়তো কেউ ভেতরে ঢুকতে পেরেছিল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তানিয়ার মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে গেছেন স্বামী মাইনুল ইসলাম। রাতে তিনি ফোনে বলেন, ‘স্ত্রীর লাশ নিয়ে যাচ্ছি। বাচ্চা দুইটা ঢাকাতেই রইল। ওদের ঠিকমতো দেখতেও পারলাম না।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-