তারিক চয়ন •
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রতিবাদে বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ডাকা জরুরি অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সমর্থনে দেশটিতে হামলা বন্ধে প্রস্তাব পাস হয়েছে।
বিশ্বের সিংহভাগ (১৪১) দেশই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ: আফগানিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ এবং নেপাল এই কাফেলায় যোগ দিয়েছে। অপর চারটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ভোটদানে বিরত ছিল।
ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভুটান ভোটদানে বিরত না থেকে নিজেদের সুস্পষ্ট অবস্থান জানান দিয়েছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত ভুটানের স্থায়ী প্রতিনিধি ডোমা শেরিং সাধারণ পরিষদে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপদ ইউরোপের সীমানা ছাড়িয়ে এখন তামাম দুনিয়ায়।
জাতিসংঘ সনদের নীতির প্রতি অনুগত সমস্ত সদস্য রাষ্ট্র ভুটানের মতো ছোট রাষ্ট্রগুলোর শান্তিপূর্ণ অস্তিত্ব এবং ভালো প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘জামিনদার’ এর ভূমিকা পালন করে। কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হুমকি বা শক্তি প্রয়োগ অগ্রহণযোগ্য, জোর দিয়ে এমন কথা বলে ডোমা ঘোষণা করেন: ‘আমরা আন্তর্জাতিক সীমানা চিত্রের একতরফা অঙ্কনকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।’
ওদিকে, ইউক্রেনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে নেপাল। ক্ষুদ্র নেপালের দুই দিকের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীন ভোটদানে বিরত থাকলেও প্রস্তাবের পক্ষে নেপালের শক্ত অবস্থান অনেকেরই নজর কেড়েছে। যদিও ইউক্রেন ইস্যুতে শুরু থেকেই অবস্থান পরিষ্কার করেছে নেপাল।
গত মঙ্গলবার জাতিসংঘে নেপালের স্থায়ী প্রতিনিধি অমৃত রাই এক বিবৃতিতে বলেন, যে কোনো সার্বভৌম দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের হুমকি বা শক্তি প্রয়োগের বিরোধিতা করে নেপাল।
ওই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল মোট ৩৫টি দেশ। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ: বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ এশিয়ার দুই নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং পরস্পরকে শত্রুজ্ঞান করলেও ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘে দুই দেশ একই সুরে কথা বলেছে। আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের কথা বলেছেন দুই দেশের দুই প্রতিনিধি। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের উপ-প্রধান মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেনও নিজ বক্তব্যে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে আহ্বান জানান।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি মুনির আকরাম বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী কূটনীতির ব্যর্থতাকেই প্রতিফলিত করে। আরও উত্তেজনা এড়াতে তিনি টেকসই সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। সামরিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অভূতপূর্ব হুমকি সৃষ্টি করে, উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেকোনো জায়গায় সংঘাতের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো।’ অন্যদিকে, ভারতের প্রতিনিধির বক্তব্য ছিল ‘ভারত অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সংঘাতপূর্ণ এলাকায় নিরাপদ মানবিক প্রবেশাধিকারের সমর্থন করে। মতপার্থক্যগুলো কেবল আলোচনা এবং কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে।’
এদিকে, প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে ওঠার আগেই আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছিল- পাকিস্তানে নিযুক্ত বিশ্বের ২২টি (অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, ইতালি, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, স্পেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, বৃটেন) দেশের রাষ্ট্রদূতরা গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, পাকিস্তান যেন জাতিসংঘে সাধারণ অধিবেশনে রাশিয়ার ওপর আনা নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেয়। যদিও দেশটির মানবাধিকার বিষয়ক মন্ত্রী শিরীন মাজারি রাষ্ট্রদূতদের ‘এমন’ আহ্বানের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
নেপাল থেকে প্রকাশিত কাঠমান্ডু পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়: গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক কারণে (জাতিসংঘের) ভোট এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র সচিব জয়নাথ কোলম্বে বলেছেন, সংঘাতের কারণে শ্রীলঙ্কার ওপর অর্থনৈতিক প্রভাব ‘তীব্রভাবে’ পড়বে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি দুইদিনের সফরে মস্কোর মাটি স্পর্শ করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। এমন সময়ে ইমরানের রাশিয়া সফর নিয়ে খোদ পাকিস্তানেই নানা সমালোচনা হলেও দেশটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, ইমরান খানের এই সফরটির সূচি অনেক আগেই নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া, পাকিস্তানের নাজুক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা এবং রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি সহযোগিতা পেতে ইমরানের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই ওই সফরটি হয়েছে বলেও অনেকের মত। তাছাড়া, চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের উষ্ণ সম্পর্কের কথা কার না জানা! এসব কিছু মিলিয়েই হয়তো পাকিস্তান ২২টি প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতদের আহ্বানেও সাড়া দেয়নি।
‘অধিক মস্কো-প্রীতিতে দু’কূলই গেল নয়াদিল্লির! এমনটাই মনে করছেন ভারতের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় শুক্রবার এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যাতে লেখা হয়েছে: ভারতের অস্ত্র সরঞ্জাম সবচেয়ে বেশি সরবরাহ করে রাশিয়া। কূটনৈতিকভাবে ভারতের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দেশও রাশিয়া। কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘে ভারতকে তারা সমর্থন করেছে।
তাছাড়া আরও একাধিকবার একাধিক ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে তারা ভারতের পাশেই ছিল। এ ছাড়াও, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেয়া মানে তাদের আরও বেশি চীনের দিকে ঠেলে দেয়া যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এ প্রসঙ্গে আনন্দবাজার কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের বরাতে বলেছে, এই যুক্তিগুলোর বেশির ভাগই স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তামাদি হয়ে গেছে। পাশাপাশি মস্কোর বিরুদ্ধাচারণ না করার ফলে রাশিয়া থেকে ভবিষ্যতে অস্ত্র কেনার বিষয়টি এখনো গলা পর্যন্ত জলে। আমেরিকা এ বিষয়ে তাদের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা থেকে আর ছাড় দেবে না নয়াদিল্লিকে।
ফলে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিকে চলতি প্রবাদে বলা হচ্ছে, আম এবং ছালা দুইই হাত ছাড়া হওয়ার জোগার। এই রিপোর্টে বলা হয়, ভারতকে সরাসরি সহায়তা করা দূরে থাক পুতিন প্রশাসনকে বরাবরি দেখা গেছে ভারতবিরোধী চীনা আগ্রাসনে চোখ বুজে থাকতে। এ কথাও বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন রাশিয়াই আফগানিস্তানের শান্তি আলোচনা থেকে ভারতকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। ২০১৯ এবং ২০২০ সনে পরপর দুবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর প্রসঙ্গ তুলেছিল চীন। কিন্তু সে সময় সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি মস্কোকে।
দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশ: ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা যখন এরকম নানান সমীকরণ মিলিয়ে ভোট দেয়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিল, তখন বাংলাদেশ কেন একই কাজ করেছে এমন প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে।
গত ১০ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর ৭ সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। সরকার প্রথমে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ‘রুষ্ট’ মনোভাব প্রকাশ করলেও পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা স্বয়ং সরকারের দায়িত্বশীল লোকদের মুখ থেকেই শোনা যাচ্ছে।
এমন এক সময়ে জাতিসংঘে ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে বাংলাদেশ ‘মানবাধিকার ইস্যু’তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলো বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। এ ছাড়া ভুটান, মালদ্বীপ, নেপালের মতো ছোট প্রতিবেশী দেশগুলো যেখানে ‘বৃহৎ প্রতিবেশী কর্তৃক ক্ষুদ্র প্রতিবেশী’কে আক্রমণের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশেরও সেরকম কোনো অবস্থান নেয়াই যৌক্তিক ছিল কিনা এই প্রশ্নই তুলছেন অনেকেই।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো জাতিসংঘে ইউক্রেন ইস্যুতে সমানভাবে বিভক্ত ছিল। চারটি দেশ প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে (আফগানিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ এবং নেপাল) এবং চারটি দেশ কোনো পক্ষ নেয়া থেকে বিরত ছিল (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা)।
ইউক্রেন ইস্যুতে এবার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভোটের এমন বিভাজন কি এই অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে? কাঠমান্ডু পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপাল ২০১৪ সালে যে ভুল করেছিল তার কিছুটা হলেও সংশোধন করেছে।
কারণ, সে সময় রাশিয়া দ্বারা ক্রিমিয়া দখলের বিষয়ে জাতিসংঘে ভোট দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিল নেপাল। সার্কের সাবেক মহাসচিব এবং নেপালের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব অর্জুন বাহাদুর থাপা বলছেন, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তানের মতো দেশগুলো ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ছোট দেশ হওয়ায় এরা সবাই ‘হস্তক্ষেপ না করার’ নীতির পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-