বৃহস্পতিবার থেকে অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে সামরিক আক্রমণ চালিয়েছে। গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে কিছুদিন ধরে প্রচার করা হচ্ছিলো, যুদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে ইউক্রেন এবং রাশিয়া। কেন রাশিয়া এই ধরনের পদক্ষেপের পথে হাঁটছে?
বস্তুত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আÍপ্রকাশ করলেও ইউক্রেন বৈশ্বিক আলোচনায় আসে ২০১৩ সালের দিকে। ওই বছর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সরকার ইউক্রেন-ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি স্থগিত করে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘ইউরোমাইদান’ নামে বিক্ষোভ দানা বাঁধে। এই বিপ্লবটা ইয়ানুকোভিচের উৎখাত এবং একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করে। ২০১৪ সালে ইয়ানুকোভিচের পতনের পর ভলোদিমির জেলেনস্কি ক্ষমতায় আসেন।
প্রসঙ্গত, ইয়ানুকোভিচ রাশিয়াপন্থি, অপরদিকে জেলেনস্কি অনেকটা পশ্চিমা-ঘেঁষা মার্কিনপন্থি হিসেবে পরিচিত।
২০১৪ সালে জেলেনস্কি ক্ষমতায় আসার পরে রাশিয়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তবে ইয়ানুকোভিচের পতনের পর জেলেনস্কি ক্ষমতা এলেও বিদ্রোহীদের দমনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে হয়। বিশেষ করে পশ্চিম অঞ্চলে দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক এলাকায় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যায় সরকার এবং বিদ্রোহীরা। এই বিদ্রোহীদের শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছিল রাশিয়া। চলমান সংঘাতের মধ্যে রাশিয়া দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চল স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং শান্তি আলোচনার অংশ হিসেবে রাশিয়ান বাহিনীকে অবস্থানের নির্দেশ দেন পুতিন। মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায় জেলেনস্কি এবং পুতিনের বিরোধ। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে নিজেদের অংশ দাবি করে রাশিয়া দখল করে।
এই বিষয়টিও ভাবিয়ে তোলে জেলেনস্কিকে। জেলেনস্কি পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট থাকায় ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশেষত ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে জোর দিতে থাকে। ন্যাটো ঘিরে রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধের বিষয়টি বিশ্ব সব সময় লক্ষ্য করে আসছে। এই ন্যাটো জোটে অংশগ্রহণকে রাশিয়া তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে পশ্চিমাদের সরাসরি সামরিক বাহিনীদের প্রাধান্য পাবে বলে মনে করে।
এই নিরাপত্তার বিষয়ের বাইরেও ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া ঘিরে রাশিয়ার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব অনেক বেশি। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে পানি ও বন্দরের বিষয়টি। ক্রিমিয়ার সেভেস্তাপোল বন্দরটি বাল্টিক সাগরে রাশিয়াকে প্রবেশ এবং সারা বছর উষ্ণ গরম পানি পাওয়ার উৎসের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তবে বাল্টিক সাগরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে রাশিয়া। বন্দর ছাড়াও ক্রিমিয়া প্রায় ২০০ বছর রাশিয়ার অংশে ছিল এবং সেখানকার জনগণ জাতিগতভাবে রুশ।
১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের হাতে হস্তান্তর করে। তখন নিশ্চয়ই ভাবনায় ছিল না, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যেতে পারে এমনকি রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। এ ছাড়া ন্যাটোর মতো সামরিক জোটের সদস্য হওয়ার চেষ্টা করতে পারে ইউক্রেন।
২০১৪ সালের পর থেকে ইউক্রেন রাশিয়ার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে এমন চিন্তা চেপে বসে পুতিনের মাথায়। রাশিয়ার ভাবনায় থাকা অস্বাভাবিক নয়, ইউক্রেন ন্যাটো জোটে গেলে সেটা রাশিয়ার ভূখণ্ডে সংঘাত ঘটানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের অনেকটা সুবিধা হতে পারে। তাই এই অঞ্চলে ন্যাটোর উপস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৯০ সালের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ বলেও অবহিত করে রাশিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গের বিষয়ে অস্বীকার করে বলা হচ্ছে, ন্যাটো একটি আত্মপ্রতিরক্ষামূলক সামরিক জোট এবং রাশিয়ার সীমান্তবর্তী খুব কম দেশই এই জোটের সদস্য।
ইউক্রেন যেন কোনোভাবেই ন্যাটোর সদস্য না হয়, সেই দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে রাশিয়া। ইতিহাসে যতবার রাশিয়া বাইরের দেশের আক্রমণের শিকার হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই ছিল উত্তর ইউরোপ থেকে। এ কারণেই রাশিয়া কোনোভাবেই চাইবে না তাদের খুব কাছে ন্যাটোর মতো পশ্চিমা সামরিক জোটের উপস্থিতি থাকুক।
অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়ায় পরমাণু শক্তির পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো গ্যাস। সমগ্র ইউরোপের তেল এবং গ্যাসের চাহিদার ২৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। লাটভিয়া, এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো গ্যাসের জন্য শতভাগ রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। জার্মানির ৫০ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। এই ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাস সরবরাহের জন্য ইউক্রেনকে প্রবেশদ্বার বলা হয়ে থেকে। রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৪০ শতাংশ পাইপলাইন গেছে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে। তাই ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া বিকল্পভাবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে জার্মানিতে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই এই প্রকল্পকে অগ্রগতিকে থামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। কারণ, ভবিষ্যতে রাশিয়া গ্যাসকে ইউরোপে রাজনৈতিক প্রভাবের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
ইউক্রেন ঘিরে রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের নিজেদের আন্তর্জাতিক প্রভাব ধরে রাখার জন্য পশ্চিমা এবং রাশিয়ার মধ্যে সংঘাতের বিষয়টি দেখছে বিশ্ব এবং বিশ্ব সংস্থা। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে ইউক্রেনে যুদ্ধ না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তবে, মস্কো কোনো কিছুই গ্রাহ্য করছে না। কারণ, যেভাবেই হোক তাদের ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে। গণমাধ্যমের বরাতে জানা যাচ্ছে, শুক্রবারও কিয়েভে মুহুর্মুহু আক্রমণ চালাচ্ছে রাশিয়া। এমনকি ইউক্রেনের দাবি, রাশিয়া তাদের রাজধানী কিয়েভে রকেট হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার ন্যাটো থেকে পূর্ব ইউরোপে স্থল এবং বিমানবাহিনী বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। ইউরো-আটলান্টিক সাগরের নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনী মোতায়েন করতে যাচ্ছে পশ্চিমা গোষ্ঠী। যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কায় লাখ লাখ মানুষ ইউক্রেন ত্যাগ করে সীমান্তবর্তী এলাকা বা পাশ্ববর্তী দেশে চলে যাচ্ছে। ইউক্রেনকে ঘিরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেন বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে!
- জি এম আরিফুজ্জামান
- রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Email: gmarif.cgs@du.ac.bd
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-