আব্দুল কুদ্দুস রানা,প্রথম আলো •
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনের অবস্থান। ৮ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে ১১ হাজার লোকের বসবাস। আর বছরজুড়ে দেশ-বিদেশের অন্তত ১২ লাখ পর্যটক এই দ্বীপে ভ্রমণ করেন। সেন্ট মার্টিনের নৈসর্গিক নীল নোনাজলে গা ভিজিয়ে পর্যটকেরা যেমন শ্রান্তি দূর করেন, তেমনি এই দ্বীপের তরতাজা খাবারে মুগ্ধ হন ভোজনরসিকেরা।
খাবারের তালিকায় তাঁদের প্রথম পছন্দ সামুদ্রিক মাছ। রূপচাঁদা, লবস্টার ও কাঁকড়া পর্যটকদের পছন্দের খাবারের তালিকায় আগে থেকেই আছে। তবে এর মধ্যে একটি মাছের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। শরীরজুড়ে ধূসর রঙের ওপর ছোপ ছোপ লাল দাগ আর নীলরঙা চোখের এই মাছের নাম ‘বোল মাছ’।
বোল মাছের এত চাহিদা কেন, উত্তর খুঁজতে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক-বর্তমান ৩ চেয়ারম্যান, স্থানীয় জেলে, হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকসহ অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হয়। সবার একটিই উত্তর, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছাড়া অন্য কোথাও এই মাছ খুব বেশি পাওয়া যায় না। প্রবাল পাথরের এলাকায় বোল মাছের বিচরণ। পাথর আছে, সাগরের এমন এলাকায় জাল ফেলা যায় না, এ কারণে ৯০ শতাংশ বোল মাছ ধরা পড়ে বড়শিতেই।
সেন্ট মার্টিন ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান (৫৭) বলেন, বর্তমানে ১ থেকে ৭৫ কেজি ওজনের বোল মাছ বড়শিতে ধরা পড়ে। পাঁচ মণ ওজনের বোল মাছ ধরা পড়ার নজিরও রয়েছে। বড় আকারের বোল মাছ ধরা পড়লে এলাকায় মাইকিং করে বিক্রি করা হয়।
দ্বীপের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, দ্বীপে হোটেল-রেস্তোরাঁ আছে দুই শতাধিক। বোল মাছ খেতে হলে আগে থেকে জানিয়ে রাখতে হয়। কারণ, হাটবাজারে বোল মাছ সচরাচর পাওয়া যায় না।
গত ২২ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে আরেক দ্বীপ ছেঁড়াদিয়ার পাথরস্তূপে ডিঙিনৌকায় বোল মাছ ধরতে নামেন স্থানীয় জেলে নুর মোহাম্মদ ও কালা মিয়া। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ৬ কেজি ওজনের একটি বোল মাছ নিয়ে ঘাটে ফেরেন তাঁরা। এরপর ৭৫০ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় মাছটি কক্সবাজারের একজন আইনজীবীর কাছে বিক্রি করে দেন জেলেরা। ক্রেতা আনিছুর রহমান বলেন, এই মাছ খুবই মজার। জীবনে যে একবার খেয়েছে, সে স্বাদ ভুলবে না।
MORE COOL STUFF
Mgid
Mgid
সেন্ট মার্টিন বোট মালিক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, দ্বীপের চারপাশে বঙ্গোপসাগরে তিন শতাধিক নৌকায় মাছ ধরেন জেলেরা। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক নৌকায় দিন ও রাতে পাথরস্তূপের ওপর বড়শি দিয়ে বোল মাছ ধরেন তাঁরা।
বোল মাছ ধরার অভিনব কৌশলের বিষয়ে জেলেরা জানান, সাধারণ বড়শি দিয়ে এ মাছ ধরা যায় না। বড়শি ফেলার কৌশলও ভিন্ন। তিন কাঁটাযুক্ত বড় আকারের (নোঙরের মতো) বড়শিতে বাঁধা হয় প্লাস্টিকের মাছ। এরপর মোটা রশির এক মাথায় মাছসহ বড়শি এবং রশির অপর মাথা বাঁধা হয় নৌকার সঙ্গে। নৌকাটি ধীরে ধীরে চলতে থাকে, তখন প্লাস্টিকের মাছটি স্বচ্ছ নীলজলের পানির নিচে দৌড়াতে থাকে। এ সময় পাথরখণ্ড থেকে বোল মাছ বেরিয়ে প্লাস্টিকের মাছটি খেয়ে ফেলে। পেটে বড়শি আটকে গেলে বোল মাছের পালানোর সুযোগ থাকে না।
কক্সবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশরাফুল হক বলেন, বোল মাছের মুখ অনেক বড়। শরীরে নানা রঙের ফোটা ফোটা দাগ থাকে। দেখতেও সুন্দর। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবাল এলাকার শীলের মধ্যে এই মাছ বেশি পাওয়া যায়। এই প্রজাতির মাছের চাহিদা অনেক, স্বাদেও অনেক মজা।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কিংবা জেলায় বছরে কী পরিমাণ বোল মাছ ধরা পড়ে, তার পরিসংখ্যান কোথাও নেই। তবে মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেরা জানান, গত বছর অন্তত ৯০০ মণ বোল মাছ বিক্রি হয়েছিল বিভিন্ন হাটবাজারে। ৯০ শতাংশ বোল মাছ বিক্রি হয়েছে কক্সবাজারে। কারণ, সেখানে চাহিদা বেশি। বাকি ১০ শতাংশ মাছ বিক্রি হয়েছে চট্টগ্রামে। অন্যান্য জেলার মানুষের কাছে বোল মাছ এখনো অচেনা।
সেন্ট মার্টিনের মৎস্য ব্যবসায়ী মো. জমির হোসেন বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ কেজি বোল মাছ আহরিত হচ্ছে। পাইকারিতে এক কেজি বোল মাছ ৭৫০ টাকা, খুচরা বাজারে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছ যত বড় হয়, দামও তত বেশি হয়।
দ্বীপের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ২০০৩ সালে পশ্চিমপাড়ার সালামত উল্লাহর বড়শিতে ধরা পড়েছিল চার মণ ওজনের একটি বোল মাছ। ২০০৬ সালে দ্বীপের পূর্বপাড়ার সিদ্দিক আহমদের বড়শিতে ধরা পড়েছিল সাড়ে চার মণ ওজনের আরেকটি বোল মাছ। তবে এখন ১৫ কেজি ওজনের চেয়ে বড় বোল মাছ তেমন ধরা পড়ছে না। বোল মাছ যখন–তখন ধরা পড়ে না। ভরা কটাল এবং মরা কটাল হিসাব করে জেলেরা সাগরে নেমে বোল মাছ শিকার করেন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-