সাধারণ রোহিঙ্গাদের পুঁজি করে বিদেশী অর্থে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে সহস্রাধিক পুরনো রোহিঙ্গা। দেশদ্রোহী ওইসব রোহিঙ্গার ইন্ধনে প্রত্যাবাসন সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি, সমাজপতি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের দোহাই তুলে বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার নিকট থেকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ নিয়ে আসছে পুরনো রোহিঙ্গারা। কিছু অংশ রোহিঙ্গাদের মধ্যে বণ্টন করে ভিডিও ফুটেজ পাঠানো হয় ওই সংস্থার কছে। রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ে আসা সাহায্যের সিংহভাগ আত্মসাত করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে সহস্রাধিক এনআইডিধারী রোহিঙ্গা।
নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া সাধারণ রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সংস্থা থেকে বর্তমানে ত্রাণ হিসেবে যা পাচ্ছে, পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা তার চেয়েও দ্বিগুণ বৃদ্ধিতে বিদেশী ফান্ড হাতিয়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত এই রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন হলে বহুবিধ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে প্রত্যাবাসনে বিরোধী হিসেবে নাটেরগুরুর দায়িত্ব পালন করছে পুরনো রোহিঙ্গারা। আবার কিছুসংখ্যক এনজিও-আইএনজিও থেকেও ঠিকাদার হিসেবে নানান কাজের কন্ট্রাক্ট নিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা কামাই করছে এক শ্রেণীর পুরনো রোহিঙ্গা।
আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কাছে আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপের ওই নেতাদের দাপট চলে বেশি। তারা পুরনো রোহিঙ্গা হিসেবে তাদের খবরদারি ও রক্ষা করে চলে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত কিছুসংখ্যক এনজিও আশ্রয় ক্যাম্পের উন্নয়নমূলক কাজগুলো পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করে থাকে। কেননা পুরনো রোহিঙ্গা নেতা হিসেবে যে কোন কথা বা সিদ্ধান্ত মেনে নেবে সাম্প্রতিক সময়ে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। ওই পুরনো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ক্যাম্পের ঠিকাদারি কাজ দিচ্ছে কিছুসংখ্যক এনজিও।
এনআইডিধারী এক রোহিঙ্গার বিবরণ তুলে ধরে অপর এক রোহিঙ্গা তথ্য প্রকাশ করে যে, শফিকুর রহমান প্রকাশ মৌলবি শফিক মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে প্রথমে ইসলামপুর মসজিদে ইমামতি করেন। তিনি আরএসও নেতা মৃত জাফর আহামদের পুত্র। প্রায় ২০ বছর আগে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে শহরের পাহাড়তলীতে আশ্রয় নিয়েছিল।
প্রথমে মসজিদে চাকরি ও পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ ইমামতি ও পাঞ্জাবি পরা বাদ দিয়ে প্যান্ট-শার্ট পরে বাংলাদেশী নাগরিক বনে যান। বিদেশী একাধিক এনজিও’র হয়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষে কাজ করে তিনি বর্তমানে বিপুল সম্পদের মালিক।
২০১৭ সালের শুরুতে বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ শহরের খুরুশকুল রাস্তার মাথায় র্যাবের হাতে আটক হয় মৌলবি শফিকের সহযোগী দুই রোহিঙ্গা। তারা বোমা তৈরির এসব সরঞ্জামাদি মৌলবি শফিকের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল বলে র্যাবের কাছে স্বীকার করেছিল। তৎক্ষণাৎ আরাকানের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আল-ইয়াকিনের বাংলাদেশের সমন্বয়ক খ্যাত মৌলবি শফিকের রোমালিয়ারছড়া চৌধুরী পাড়ার বসতগৃহে অভিযান চালায় র্যাব। তবে খবরটি আগেই জানতে পেরে সুচতুর ভয়ঙ্কর এই রোহিঙ্গা জঙ্গী মৌলবি শফিক পেছনের গেট দিয়ে পালিয়ে যায়।
সূত্র জানায়, পুরনো রোহিঙ্গা নেতা মৌলবি ইদ্রিছ জিহাদী, শায়খ ছালামত উল্লাহ, নুর কামাল, মৌলবি আয়াছ, রুহুল আমিন, হাফেজ হাসিম, হাফেজ ছলাহুল ইসলাম, ডাক্তার আয়ুব, মৌলবি নুর হোসাইন, এনায়েত আবু সিদ্দিক আরমান ও স্থানীয় বিকাশ সিন্ডিকেটের আলী , রফিক উদ্দিনসহ ১৫ হাজার পুরনো রোহিঙ্গা এনআইডি হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের বাংলাদেশী দাবি করছে। তারাই মূলত রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণ।
তাদের রয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে একাধিক সুরম্য অট্টালিকা, বহু জমি-জমা ও প্লট। পাহাড়তলীতে জমি কিনে বাড়ি করেন মৌলবি শফিক। পরে কিছু ঝামেলার কারণে পাহাড়তলী ছেড়ে চলে যান শহরের গুদার পাড়া ও চৌধুরী পাড়ায়। সেখানে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে জমি কিনে দুটি আলিশান বাড়ি করেছেন। দুই দালানে রয়েছে দুই স্ত্রী। একজন রোহিঙ্গা ও অপরজন বাংলাদেশী নারী। এছাড়া প্রথম স্ত্রী রেনুয়ারার রয়েছে ৩ মেয়ে ১ ছেলে। সেই ছেলে বর্তমানে কুষ্টিয়া জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজে পড়ে। দ্বিতীয় স্ত্রী দিলরুবা খানম তার ঘরেও রয়েছে ২ ছেলে। মৌলবি শফিকরা ৬ ভাই ৩ বোন। ভাইয়ের মধ্যে মোহাম্মদ জমির থাকে পিএমখালী ছনখোলা পূর্ব ঘোনারপাড়ায়। মোহাম্মদ কামাল সৌদি আরবে মারা গেছেন। মাহাবুবুর রহমান সৌদি আরবে থাকেন সপরিবারে। ওবায়দুর রহমান মুদি দোকানি ও এখলাছুর রহমান ছনখোলা আয়েশা ছিদ্দিকা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। বোনের মধ্যে রাবেয়ার বাড়ি পিএমখালী কাঁঠালিয়া মোরা। শামিমা আকতার ছনখোলায় এবং তৃতীয় বোন ইয়াছমিন আক্তার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে।
জানা গেছে, পুরাতন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রশ্রয় ও নতুন আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইয়াবা ব্যবসাসহ নানান অপকর্ম করে যাচ্ছে পুরনো রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। নতুন রোহিঙ্গারা তাদের পূর্ব পরিচিত অথবা নিকট আত্মীয় হিসেবে আপদের সময় শহরে থাকা ওই রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পুরনো রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ক্যাম্পে ইতোমধ্যে গঠন করেছে আল-ইয়াকিনের (আরসা) কমিটি। একসময় সরকার বিরোধী নাশকতা মামলার আসামি হয়ে জেল খেটেছে মৌলবি শফিক, শাইখ ছালামত উল্লাহ, মৌলবি আয়াছ ও হাফেজ ছলাহুল ইসলাম। তাই ঝামেলা এড়াতে তারা নিজেদের আড়াল রেখে চলাফেরা করছে। মৌলবি শফিকের বাড়িতে অচেনা বহু রোহিঙ্গা নেতার যাতায়াত রয়েছে, সেটা এলাকার অনেকে জানেন। তবে তার এত অপকর্মের কথা অনেকে জানে না। স্থানীয়রা বলেন, অনেক রোহিঙ্গা নেতা এখানে বাড়ি করে নানান অপকর্ম করছে। এনআইডিধারী রোহিঙ্গাদের এখনই লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
ভবিষ্যতে তাদের ইন্ধনে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা যাবে না। তাই ওই দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী।
• জনকন্ঠ /সিবিজে
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-