মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা •
কক্সবাজারের একটি রোহিঙ্গা শিবির থেকে সম্প্রতি প্রধানের এক ভাইকে গ্রেপ্তারের ঘটনা শরণার্থী শিবিরে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উপস্থিতির দৃঢ় ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করছেন সেখানকার বাসিন্দা এবং বিশেষজ্ঞরা। যদিও এ বিষয়ে সরকারের দাবি ঠিক এর বিপরীত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারে নিষিদ্ধ সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মোহাম্মদ শাহ আলীকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে সরকারের গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা উচিত। তদন্ত শুধু রোহিঙ্গা শিবিরে আরসা সদস্যদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্যই নয়, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি।
তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) একটি দল গত ১৬ জানুয়ারি আরসা কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আমার জুনুনীর ভাই শাহ আলীকে কক্সবাজারের উখিয়ার নৌকারমাঠ রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারের পর এপিবিএন তার বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলার নথি অনুসারে, স্থানীয়ভাবে জানা গেছে যে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ‘একজন চিহ্নিত আরসা সদস্য’।
এতে আরও বলা হয়েছে, সে (শাহ আলী) একজন সশস্ত্র অপরাধী, অপহরণের সঙ্গে জড়িত একটি গ্যাংয়ের প্রধান এবং মাদক চোরাচালান করেন। জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত স্বীকার করেছে যে, তিনি মাদক চোরাচালান করার সময় নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতেন।
দেশে আরসার উপস্থিতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ার কারণ রোহিঙ্গা ও বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যরা রয়েছে। গত বছর জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মহিব উল্লাহকে হত্যার পর এটি আলোচনায় আসে।
যদিও, সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাবি করছে বাংলাদেশে এই গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই এবং কিছু অপরাধী শরণার্থীদের ভয় দেখানোর জন্য নিজেদেরকে আরসা সদস্য বলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে থাকতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত। কারণ এটি রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, ‘রোহিঙ্গা নেতা মহিব উল্লাহর মৃত্যুর তদন্ত এবং সীমান্তের ওপারে আরসার বাহ্যিক যোগসূত্রের বিষয়ে প্রমাণ খোঁজার জন্য এই গ্রেপ্তারটি (শাহ আলী) গুরুত্বপূর্ণ হবে।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, সাধারণত মনে করা হয় যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরসার উপস্থিতি রয়েছে এবং তারা সেখানে বিভিন্ন অপরাধের জন্য দায়ী।
তিনি বলেন, ‘শিবিরে আরসার অনুসারীরা আছে, বিশেষ করে যারা প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করে তাদের মধ্যে। আমার মনে হয় রোহিঙ্গা শিবিরে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা উচিত, যাতে তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’
যোগাযোগ করা হলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি অংশের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কমান্ডার নাইমুল হক বলেন, ‘আমরা বলিনি শাহ আলী একজন আরসা সদস্য। আমরা বলেছি তিনি একজন তথাকথিত আরসা সদস্য।’
তিনি বলেন, শাহ আলী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছেন, তিনি সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। কিন্তু আতাউল্লাহর ভাই হওয়ায় তার ভিসা বাতিল করা হয়েছে।
নাইমুল হক বলেন, ‘তারপর বিয়ে করে এখানেই থেকে যান।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা শুনেছি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা আছে কিন্তু ক্যাম্পে চিহ্নিত কোনো আরসা সদস্য পাওয়া যায়নি।
তবে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কে আরসা বা কে আরাকান আর্মির সদস্য সেটা কোনো বিষয় নয়। যেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
ভেরিফাইড টুইটার অ্যাকাউন্টে আরসা দাবি করেছে, আরসার সাবেক সদস্য শাহ আলি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং ক্যান্সারেও ভুগছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এ কারণে আড়াই বছর আগে তাকে আরসার সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘সরকার আরসার বিষয়টি এখনও কেন অস্বীকার করছে তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আমি বিশ্বাস করি আরসা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর এজেন্ট এবং তারা ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা নির্মূল করার জন্য তাতমাদওকে অজুহাত তৈরি করে দিয়েছে।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আরসা উত্তর রাখাইন জুড়ে পুলিশ পোস্টে হামলার দায় স্বীকার করে। এটিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। যার ফলে কয়েক দশকের মধ্যে এই অঞ্চলে সবচেয়ে গুরুতর শরণার্থী সংকট দেখা দেয়।
সূত্র জানায়, কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সবগুলোই সংগঠিত ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধের কেন্দ্রস্থল বলে বিশ্বাস করে সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
স্থানীয়রা এবং গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, শরণার্থী শিবিরগুলোকে শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করতে সশস্ত্র দলটি আইনের শিথিল প্রয়োগ এবং উদ্বাস্তুদের দুর্দশার সুবিধা নিচ্ছে।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা এবং রোহিঙ্গা নেতা বলেন, বিপুল সংখ্যক আরসা সদস্য মিয়ানমারের এজেন্ট এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা পায়।
ওয়াইকং ক্যাম্পের একজন নেতা জানান, তারা জানতেন না যে শাহ আলী ক্যাম্পে থাকে।
তিনি বলেন, ‘শাহ আলীকে যেহেতু গ্রেপ্তার করা হয়েছে, নিশ্চয়ই আরসার আরও অনেক নেতা ক্যাম্পে বসবাস করছেন। তাদেরও দ্রুত গ্রেপ্তার করা উচিত।’
কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ নুর বলেন, মহিব উল্লাহকে হত্যার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাম্পে নিয়মিত অভিযান চালালেও রাতে ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে আরসা।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পক্ষে আন্দোলনকারী নাগরিকদের সংগঠন আমড়া কক্সবাজারবাসীর সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘তিনি (শাহ আলী) কীভাবে এনআইডি কার্ড পেলেন? কারা তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা উচিত। তার পেছনে কারা আছেন?’
১৪ এপিবিএন কমান্ডার নাইমুল হক বলেন, মহিব উল্লাহকে হত্যার পর তারা বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩০০ তথাকথিত আরসা সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছেন।
তিনি আরও জানান, তথাকথিত আরসা সদস্যদের অনেকেই আদালতে জামিন পেয়েছেন, জামিনে বেড়িয়ে আবার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন এবং আবার গ্রেপ্তার হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন খুবই ভালো। ক্যাম্পগুলোকে কেন্দ্র করে সার্কুলার রোড তৈরি প্রায় শেষ হয়েছে এবং আমরা ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে টহল নিশ্চিত করেছি।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-