বাংলাদেশি এনআইডি ও রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :

টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে কোনও ভালো খবর আসছে না। আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহর ভাই শাহ আলীকে গ্রেফতার করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। এটি যতটা না বড় খবর, তার চেয়ে উদ্বেগের খবর হলো, এই রোহিঙ্গা নাগরিক চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার দেওয়ান বাজার এলাকার স্থায়ী ঠিকানায় বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়েছেন।

গত রোববার শাহ আলীকে অস্ত্র, মাদকসহ গ্রেফতারের পর উখিয়া থানায় করা মামলার এজাহারে পুলিশ এ তথ্য উল্লেখ করেছে। শাহ আলীর কাছে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে, যেখানে তার স্থায়ী ঠিকানা লেখা আছে দেওয়ান বাজার জয়নব কলোনি।

গত বছর ২২ অক্টোবর ভোরের দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ১৮ নম্বর ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ছয় জনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর আগে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রত্যাবাসনপন্থী নেতা মুহিবুল্লাহসহ গত বছরের অক্টোবরে সংঘটিত ছয় খুনের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে। স্বভাবতই আরসা নেতা আতাউল্লাহর ভাইয়ের কাছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ তৈরি হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়মিত ঘটছে খুনখারাবির ঘটনা। রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তায় এখন সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয় আরসাকে।

২০১৯ সালে ডাকাত নূর আলম নিহত হওয়ার পর তার কাছে ডিজিটাল আইডি কার্ড পাওয়া গিয়েছিল। তখন খবর বেরিয়েছিল যে ইসি সার্ভারে ৪৬ থেকে ৭৩ জন রোহিঙ্গার নাম অন্তর্ভুক্ত করা আছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা বহুগুণ বেশি। তাই রোহিঙ্গারা কীভাবে স্মার্ট কার্ড ও পাসপোর্ট পায় সে আলোচনা চললেও থেমে নেই এই দুর্নীতি।

আরসা প্রধানের ভাই কীভাবে চট্টগ্রাম শহরের ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র নেন, তার উত্তর মিলছে না কারও কাছেই। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কেউই এখন পর্যন্ত কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিয়মিত গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোকে রোহিঙ্গা ডাকাত বা চোরাকারবারিদের কাজ বলা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার পর ক্যাম্পে সক্রিয় বিভিন্ন পক্ষের অনেক বিষয় এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচনায় আসছে। এবং এবার আরসা নেতা আতাউল্লাহর গ্রেফতার হওয়া, তার কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া প্রমাণ করে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছি আমরা।

২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গার স্রোত নামার পর যত দিন যাচ্ছে ততই আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। গত বছরের কয়েকটি বড় খুনের ঘটনার পর হামলার ভয়ে রোহিঙ্গাদের অনেক নেতা ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টা আছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ক্যাম্পের ভেতরে দিনের বেলায় এক রকম চিত্র থাকলেও রাতে চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। ক্যাম্পের ভেতরে একটা কথা প্রচলিত আছে, ক্যাম্প দিনের বেলায় বাংলাদেশের আর রাতের বেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পদচারণা শুরু হয়। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে পৌঁছাতে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়। ফলে যেকোনও অপরাধ করে দ্রুত পালিয়ে যাওয়া সম্ভব। রাতের বেলায় এসব জায়গায় যেতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও নিরাপদ বোধ করেন না।

মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডসহ গত বছরের বেশ কিছু ঘটনার পর এখন পর্যন্ত বড় অঘটন নেই। তবে আরসা প্রধানের ভাইয়ের গ্রেফতার হওয়া প্রমাণ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে সশস্ত্র গ্রুপগুলো সক্রিয় আছে এবং এর স্থানীয় একটি স্বার্থান্বেষী মহলের মাধ্যমে এরা জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাচ্ছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পে দ্বন্দ্বের নানামুখী কারণ আছে। রেজিস্টার্ড এবং নন-রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। এর বাইরে সশস্ত্র আরসার অবস্থানের বিষয়টি ধোয়াশাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ক্যাম্পে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর পক্ষে কাজ করে এমন কয়েকটি গ্রুপও রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কক্সবাজার অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষাগত ও শারীরিক গঠনে মিল থাকায় ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে তারা মিশে যাচ্ছে, যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এসব গ্রুপের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে থাকে। অপহরণের পাশাপাশি এসব গ্রুপ ইয়াবা ও আইসের মতো মাদক ও অস্ত্রের পাচার, ব্যবসা, চোরাচালান ও রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে যৌন ব্যবসাও করছে। রোহিঙ্গারা যেন কাঁটাতার ডিঙিয়ে বাইরে যেতে না পারে, সে ব্যাপারে তৎপরতা চালাতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে।

ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের বড় বড় ১০ হাজারের অধিক দোকানপাট রয়েছে। শরণার্থীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করছে বাংলাদেশ সরকার, অথচ তারা ব্যবসা করছে। এই ব্যবসা ঘিরেই যত সমস্যা। তারা ব্যবসা করে, মাদক ও সোনা চোরাচালান করে চাহিদার অতিরিক্ত টাকা পাচ্ছে, সেই টাকায় অস্ত্র কিনছে, অবৈধ পথে খরচ করছে, সঙ্গে বাংলাদেশের ঝুঁকিও বাড়ছে। এই ব্যবসা বন্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

সবার আগে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেই গুরুত্ব দিতে হবে। যদিও প্রত্যাবাসন নিয়ে আমাদের সামনে কোনও সুখবর নেই। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একের পর এক খুনের ঘটনা নিয়ে ভাবতে হবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে। রাতের বেলা কেন ক্যাম্প খুনিদের দখলে চলে যায় তার উত্তর খুঁজতে হবে। আর সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে ভালোভাবে তদন্ত করতে হবে এই জাতীয় পরিচয়পত্রের ইস্যুটি। প্রায় ২০টি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় আছে পুরো অঞ্চলে। এরা বাংলাদেশের নাগরিকদের অপহরণ করছে, টাকা দাবি করছে, হত্যা করছে। টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয় লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করাই অপহরণকারী বাহিনীর কাজ।

রোহিঙ্গাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট যায় কীভাবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় একটি চক্র টাকার বিনিময়ে তাদের হাতে এগুলো তুলে দিয়েছে। এর সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধিও জড়িত। রোহিঙ্গারা যেন কোনোভাবেই জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট না পায় সেটা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। যারা তাদের হাতে এগুলো তুলে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতোমধ্যে যেসব রোহিঙ্গার হাতে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট রয়েছে সেগুলো অবশ্যই সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে, যাতে এগুলোর অপব্যবহার না হয়।

লেখক: সাংবাদিক

আরও খবর