কক্সবাজার জার্নাল ডেস্ক •
চলতি শীতে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বস্তি থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প, আবাসিক ভবন কিংবা ফার্নিচার কারখানা, গত কয়েকদিনে কোথায় লাগেনি আগুন! সম্প্রতি আগুনের তাপ পুড়িয়েছে নদীর বুকে থাকা লঞ্চকেও।
দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল। আহতরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে। বার্ন ইউনিটে ভিড় বাড়ছে দগ্ধদের।
৫ কারণে আগুন লাগছে বেশি
দেশে অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে যে পাঁচটি বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো হলো- ভবনে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, ভবন তৈরিতে আইন অমান্য করা (নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল থাকা), বিড়ি-সিগারেট ও রান্নার চুলা সম্পর্কে সতর্ক না থাকা এবং নাশকতার অভিযোগ।
সাম্প্রতিক অতীতে দেখা গেছে, অধিকাংশ বড় বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের পর-পরই কোনো না কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে উঠেছে নাশকতার অভিযোগ। এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তরা বেশ জোর গলাতেই বলেছেন, ‘উচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হয়ে এ পথ ধরেছে দুর্বৃত্তরা।’
তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকার কারণেই আগুন সহজে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ভবন তৈরিতে আইন অমান্য করাও একটি কারণ। ভবনের নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল থাকায় দুর্ঘটনার সময় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ধরন ও তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ফায়ার সার্ভিস আরও বলছে, বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক গোলযোগ। অর্থাৎ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সহজেই শর্টসার্কিট হয়ে আগুনের ঘটনা ঘটছে। আবাসিক ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও এখন আগুন লাগার প্রধান কারণ এ রকম নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার। এসব স্থানে আগুন লাগার আরেকটি বিশেষ কারণ হলো বিড়ি-সিগারেট ও রান্নার চুলা।
সতর্কতায় যা যা করা চাই
চলছে শীতকাল। নানা কারণে বছরের এই সময়টাতে দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। কখনও কখনও ঘটে প্রাণহানির ঘটনাও। কিন্তু একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেই অগ্নিদুর্ঘটনা কমিয়ে আনা বা এড়িয়ে যাওয়া যায়।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সরোয়ার জাহান জানালেন তেমন কিছু পরামর্শ।
ড. সরোয়ার জাহান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। শীতকালে আবহাওয়াগত একটা কারণ তো আছেই। এ সময় আবহাওয়াটা একটু শুষ্ক হয়ে যায়। অন্যদিকে বর্ষাকালে ভেজা ভাব থাকে। ফলে অবশ্যই আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে যাওয়া আগুন লাগার ক্ষেত্রে একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। তবে একথা ঠিক নয়- শীতকালে বলেই আগুন লাগে। এখানে আগুন লাগার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে- আমাদের এখানে বেশ কয়েক ধরনের বিল্ডিং আছে। কাঁচা, সেমিপাকা এবং পাকা। সাধারণভাবে কাঁচা স্ট্রাকচারে আগুন লাগার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তুলনামূলকভাবে পাকাতে কম থাকে।
তিনি বলেন, পাকা স্ট্রাকচারে যেটা হয়ে থাকে সেটা হচ্ছে- আসলে আমাদের ফায়ার প্রটেকশনের তেমন ব্যবস্থা থাকে না। যেমন দেখা যায় অধিকাংশ ভবনেই স্মোক ডিটেক্টর পাওয়া যাবে না। তাছাড়া বৈদ্যুতিক লাইন যেটা টানা হয় সেখানেও খুব একটা সেফটি মেজর নেওয়া হয় না। ফলে প্রায়ই দেখা যায় শর্টসার্কিট হয়ে থাকে। বলা চলে খুবই অপরিকল্পিতভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ এবং ওয়্যারিংয়ের কাজ করা হয়ে থাকে। এসব কারণে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেই আগুন লাগে। ফলে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায়, পাকা ভবনে আগুন লাগার প্রধানত দুটো কারণ। শর্টসার্কিট ও ফায়ার প্রটেকশন।
বুয়েটের এই শিক্ষক আরও বলেন, অপরিকল্পিতভাবে ভবন বানানোর ফলে অনেক স্থানে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও যন্ত্রপাতি ঢোকানোও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। আগুন কেন লাগতে পারে এ বিষয়টি হয়তো অনেকে বোঝেন না। এ ব্যাপারে অনেকেই সচেতন না। বিশেষ করে মার্কেটগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেড়ে ওঠে অপরিকল্পিতভাবে। তাছাড়া বিদ্যুতের কানেকশন কীভাবে নিতে হবে, কীভাবে ওয়্যারিং করতে হবে- এ বিষয় সম্পর্কে অনেকের সচেতনতার অভাব রয়েছে। জনসচেতনতার পাশাপাশি ফায়ার ডিটেক্টরের যে বিষয়টি বললাম- এটা যদি থাকে ভবনে, তাহলে আগুন লাগলেও খুব তাড়াতাড়ি তা নেভানো সম্ভব।
এক্ষেত্রে সরকারের একটা বড় ভূমিকা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে মনিটরিং থাকা দরকার। যেমন ধরুন- রাজধানী ঢাকার প্রতিটি ভবনের অনুমতি দেয় রাজউক। প্ল্যানসহ যাবতীয় বিষয়ের অনুমতি রাজউকের কাছ থেকে নিতে হয়। ফলে সেখানে কর্তৃপক্ষের একটা দায়িত্ব আছে আগুন লাগা সম্পর্কিত বিষয়টি ভেবে দেখা এবং সে হিসেবে মনিটর করা। কাজেই জনসচেতনতা এবং কর্তৃপক্ষের মনিটরিং একান্ত দরকার। এর পাশাপাশি প্রতিটি ভবনে ফায়ার প্রটেকশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের সেবা ও যোগ্যতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা একেবারে কার্যকর না একথা বলব না। তবে একইসঙ্গে একথা বলব যে- এর কার্যকারিতা খুবই কম। কম এই অর্থে বলছি- ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য পরিকল্পিত লোকেশন পাওয়া যায় না। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি- ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থা কোথায় থাকবে। তাদের আওতাধীন এলাকা কতটা থাকবে। কীভাবে যাবে- এসব বিষয়। নানারকম গবেষণা করে এ ধরনের লোকেশন ঠিক করা উচিত।
তিনি বলেন, আগে বাংলাদেশ একসময় পুকুরে ভরা ছিল। যেকোনো রাস্তার পাশে পুকুর বা পানির ব্যবস্থা থাকত। কোনো জায়গায় আগুন লাগলে তখন যেকোনো জায়গা থেকে পানি পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে সে ব্যবস্থা নেই। ফলে পানি পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া মার্কেট এবং আবাসিক ভবন এলাকায় যত দ্রুত পানি পাওয়া যায় এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু দেখা যায় বর্তমান বাস্তবতায় সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।
এছাড়া দেশে থাকা ফায়ার ইকুইপমেন্ট বা যন্ত্রপাতি যা আছে সেগুলো ঠিকভাবে ব্যবহার করার মতো কর্মীর সংখ্যা কম উল্লেখ করে সরোয়ার জাহান বলেন, অগ্নিনির্বাপণ কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। একইসাথে যন্ত্রপাতিরও অভাব রয়েছে। তাছাড়া কত লক্ষ মানুষের জন্য কতটা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন দরকার এবং কোন জায়গায় সেটা হবে এ ধরনের কোনো সঠিক স্টাডি করা হয় না এবং পরিকল্পনাও করা হয় না। ফলে এককথায় বলতে গেলে, প্ল্যানিং, ট্রেনিং এবং যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। ফলে সবকিছু মিলিয়ে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং যদি না বানানো হয়, লোকেশনাল প্ল্যানিং যদি না করা হয়, একইসঙ্গে পানির যদি সুব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে অবস্থার খুব একটা উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
অগ্নিকাণ্ডের পেছনে নাশকতাও একটি কারণ হতে পারে বলে মতপ্রকাশ করেন ড. সরোয়ার। তিনি বলেন, অনেক সময় শোনা যায় অনেক বস্তিতে আগুন লাগে বস্তি উচ্ছেদ করার জন্য। এগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ অনেক নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি নাশকতা কি-না সেটা নিরূপণের জন্য আধুনিক যে প্রযুক্তি ব্যবহার করার কথা সেটাও আমরা এখনও করতে পারছি না। নাশকতা নাকি অন্যকিছুর কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, সেটা নির্ধারণের বিভিন্ন ধরনের পন্থা আছে। সেগুলোও জানতে হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-