দণ্ড কার হাতে, কোথায় চলেছি

চার দিকে সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের কথাই ধরা যাক। দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম বলছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ, আমাদের ভুল থাকলে সংশোধনের চেষ্টা করব : পররাষ্ট্রমন্ত্রী।’ আর খবরের ভেতরে, মানে বডির শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘কিছু দেশের যদি বাংলাদেশের প্রতি অসন্তোষ থাকে তবে আমরা তা দূর করব। আমাদের লক্ষ্য হলো সব দেশের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা। কোনো কারণে কিছু দেশের আমাদের প্রতি অসন্তোষ থাকতে পারে। আমরা ওই সব কারণ খুঁজে বের করব।’

প্রথমত, এটি খুবই অসহায়ের এক বক্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি দেশের সরকার মানে অথরিটি বা কর্তা। ক্ষমতার কর্তা। তা হলে ক্ষমতার কর্তা আর অসহায়ত্ব একসাথে? সরি, এ দু’টি একসাথে হয় না। যখনই এমনটি দেখা যায় এর মানে সরকার দুর্বল হয়ে গেছে কিংবা ক্ষমতা অর্ধেক হয়ে গেছে। এটি অকল্পনীয়; কারণ এখান থেকেই এরপর উঠবে ক্ষমতাচ্যুতির আলাপ আলোচনা।

দ্বিতীয়ত, সরকার কার ‘অসন্তোষের’ কথা বলছে? আমল করেছে বলে জানাচ্ছে? বলেছে, ‘কিছু দেশের’ বা ‘যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ’। লক্ষণীয়, এতে সরকার মানে যা সর্বময় ক্ষমতার উৎস হওয়ার কথা হলেও তার উপরে বা বাইরের এক ক্ষমতার কথা বলা হচ্ছে এখানে। এমনকি আবার যার কাছেই সরকার অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে!

তাতে এটি পরিষ্কার সেই ‘উপরের’ ক্ষমতা পাওয়ারফুল এবং পাওয়ারফুল বলে স্বীকার করে নেয়া মোমেনের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে। অনেকে এটিকে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ব্যাপারের দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায় কি না, সে চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু না সে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করা ভুল হবে। কারণ যারা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে তারা সেসব কথার কোনোটাই বাংলাদেশের কোনো পাবলিক এমনকি কোনো গ্রুপ অব পাবলিকের দিকে তাক করে নেই। কারণ আমেরিকা অভিযোগ করেছে সুনির্দিষ্ট কিছু সরকারি কর্তা আর ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এবং গুরুত্বপূর্ণ যে, এসব অভিযোগ আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ। তবে আমেরিকার এসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সংশ্লিষ্ট নিকট আত্মীয়রা যাতে আমেরিকান নেতৃত্বে থাকা গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ব্যবহারের সুযোগ আর না পায় এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যেহেতু এ ব্যবস্থাটা মার্কিন ডলার কেন্দ্রিক তাই আমেরিকার একা নিজ হাতেই কেবল এ বাড়তি সুবিধাটা আছে।

আসলে মন্ত্রী মোমেনের বক্তব্য আমেরিকার এই সক্ষমতাটাকে বৈধ বলে স্বীকার করে নিয়ে বলা। যেমন বাইডেনের আমেরিকা বলছে, ‘বাংলাদেশ সরকার তোমার নাগরিক যারা এমন বেশ কিছু জনগণের অংশের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছ। যদি তুমি বাংলাদেশের পাবলিকের সরকার হয়ে থাক তবে তোমার যেখানে উচিত ছিল তাদের অধিকার রক্ষা করা। অথচ তুমি করেছ উল্টা, তুমি অপরাধী।’

এখন একটা হতে পারত যে সরকার বুক ফুলিয়ে দাবি করত, প্রমাণ দিত যার সারকথা হতো যে, আমি এসব অপরাধ করিনি। কিন্তু এখানে তা হয়নি। মন্ত্রী মোমেন বলেছেন, ‘আমাদের ভুল থাকলে সংশোধনের চেষ্টা করব’; ‘অসন্তুষ্ট দেশকে সন্তুষ্ট’ করার চেষ্টা করব ইত্যাদি; অর্থাৎ একেবারেই সাবমিসিভ বা অধস্তন করে ফেলেছেন নিজের অবস্থান। এর মাধ্যমে সরকার নিজেও আর বাইরের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে না। আর তাতে শুধু সে অধস্তনই নয়, নিজেকে অনুগ্রহ লাভের প্রার্থী হিসেবে হাজির করেছে। আর সেখান থেকেই, আমাদের সরকার নিজ জনগণের আর কোনো প্রতিনিধিই নয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত জনঅধিকার সুরক্ষাকারীও কেউ নয়- এমন হয়ে গেছে।

বরং সরকার ব্যস্ত হয়ে গেছে কেবল নিজে সরকারকে রক্ষা এবং কেবল ওই সব সরকারি কর্তাকে কী করে রক্ষা করবে, সেই কাজে। আর এ কাজে বাংলাদেশের সরকার আমেরিকান সরকার-প্রশাসনের অনুগ্রহ-প্রার্থী হয়ে গেছে। এখানে প্রধান লক্ষণীয় হলো, যারা ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিক, যারা গুম হয়েছেন, যাদের ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে ইত্যাদি এরা এখানে কোনো প্রসঙ্গই নয়। প্রসঙ্গটা হলো, সরকার টিকানো এবং সরকার, সরকারি কর্তা ও অফিসের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কিভাবে প্রত্যাহার করে নেয়া যায়। যেন মামলাটা হলো, বাংলাদেশের পাবলিক নয়, সরকারের নিজ স্বার্থ আর আমেরিকার প্রশাসনের মধ্যকার! মোমেনের বক্তব্য প্রকারান্তরে ইস্যুটাকে সেখানে নিয়ে গেছে।

সাধারণত কোনো সৎ-ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম হলো, তার বিরুদ্ধে কোনো বড় অভিযোগ উঠলে কোনো স্বাধীন নিরপেক্ষ আইনি কমিশন গঠন করে তাকে নিয়ে তদন্ত করা এবং সত্য উদঘাটন করা। কিন্তু এখানে কী চলছে? পুরা উল্টা। বলা হচ্ছে, কেউ মার্কিন সরকারকে ‘ভুল বুঝিয়েছে’ কি না। যদিও নিষেধাজ্ঞা আরোপের উৎস প্রথমে আমেরিকান সংসদ ও সিনেট কমিটি থেকে পরে প্রেসিডেন্ট, এভাবে। তার মানে এখানে কোনো ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং হবে না। ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকরা এখান থেকে কিছু প্রতিকারই পাবে না।

দুই দিন আগে বিবিসি একটা রিপোর্ট করেছে, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা : বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা বিধিনিষেধ প্রত্যাহারে কী তৎপরতা চালাচ্ছে?’ এতে বাংলাদেশ সরকারের সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলছেন, ‘নিশ্চয়ই আমেরিকা সরকারকে কনভিন্স করা হয়েছে। কাজেই যে তথ্যের ভিত্তিতে দিয়েছে, সেই তথ্য যতটুকু আছে সেটি কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ্যা বা সঠিক কী সঠিক নয়- এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে একটা বক্তব্য যাবে।’ ‘এ ছাড়া আমেরিকাতে লবিস্ট নিয়োগের একটি কালচার আছে, সেই লবিস্ট নিয়োগ করে আমেরিকান সরকারকে বোঝাতে হবে। আর ব্যক্তিদের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা সেটি প্রত্যাহার চেয়ে আমেরিকা সরকারের কাছে আপিল করতে হবে।’ অর্থাৎ তিনি বাইডেন প্রশাসনের সাথে ক’টা ‘ডিল’ করার কথাই বলছেন; অর্থাৎ লক্ষণীয় মুখ্য পয়েন্ট ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্টস যাচাই নয়, একটি লেনদেন বা ‘ডিল’ হয়ে উঠেছে সরকারের করণীয়!

ডয়েচ ভেলেতে ছাপা হওয়া ‘আসক’-এর দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ক্রসফায়ারে ২০১৬ সালে মোট ১৭৭ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা কমে ১৪১ জনে নেমে আসে। এর পর থেকে গতি আবার বাড়তে শুরু করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন ও মাদকবিরোধী অভিযান ক্রসফায়ারের নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। পরের বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৪২১ জন, যা আগের বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি। ২০১৯ সালেও এই ধারা অব্যাহত ছিল, ৩৬১ জনের বেশি। সেই ধারাবাহিকতা বজায় আছে। এখান থেকে অনুমান করলে বের হয়ে আসে যে, সরকার ক্রমেই এমন ‘হত্যা-নির্ভরশীল’ একটি সরকার হয়ে গেছে। সাধারণত যেটা দেখা যায়, একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরিতে কোনো সরকার একবার সফল হয়ে গেলে পরে দেখা যায় এর পর থেকে সে বিরোধিতাহীন বা বাধাহীন এক সরকার হয়ে ওঠে।

তা হলে এ তথ্যাবলি আরেকটি ইঙ্গিত দেয় যে, ধরা যাক আমরা একটি ‘ডিল’ যদি দেখতে পাইও সেই ডিল উপস্থিত সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই যদি করতেই হয়, তবে সেই সাথে এসব ক্রসফায়ার বা গুম প্রভৃতিতে মাসে মাসে কমপক্ষে ৩৫ জনকেও বলি দিতে রাজি থাকতে হবেই। কারণ প্রশাসন ভয়ের সংস্কৃতি বা হত্যা-নির্ভরশীল হয়ে গেছে! এই ক্ষিধাও পূরণ করতেই হবে। এই প্রসঙ্গে বিবিসিকে লিখেছে, ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ বাস্তবতায় র‌্যাবের কার্যক্রমে একটা সংস্কারের সুযোগ আছে বলেও মনে করেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক।

‘সংস্কার করতে হলে বেপরোয়াভাবে যেন কিছু না হয়। সব কিছু কন্ট্রোলের মধ্যে রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আপনি গুলি করবেন এনকাউন্টার, আপনি বিপদে পড়েছেন, দুষ্কৃতকারীরা আপনাকে হামলা করছে সে ক্ষেত্রে ব্রাশফায়ার করে মানুষ মারতে থাকলে তো হবে না। আপনাকে বাঁচানোর জন্য যতটুকু করার দরকার অতটুকুই করতে হবে। এ সংস্কারটা আনতে হবে।’ তার মানে তামাশাটা হলো, সাবেক এই আইজিপিও এখন সংস্কারের কথা বলছেন; অথচ তার কার্যকালে (২০১৫ সালের শুরু থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি) গুম ও ক্রসফায়ারের কিছু পরিসংখ্যান উপরে দেখেছি।

মাছ খাবো না
বিড়াল কি মাছ খাবো না বলতে পারে? মানে যেটা স্বভাব হয়ে গেছে বা যাতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তা কি সে ছাড়তে পারে? তাহলে সাবেক আইজিপির কথিত সংস্কারটাও যদি করে নেয়াও হয় তবুও উপস্থিত সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে পারবে না। কারণ, এরা হত্যা-নির্ভরশীল সরকার হয়ে গেছে।

তা সত্ত্বেও এমনকি ধরা যাক, কোনো ডিল হয়ে গেল। বিবিসির ওই রিপোর্টে এক আমেরিকান বিশ্লেষক প্রশান্ত পরমেশ্বরণের কথা এনেছে তারা। তিনি বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে যেহেতু কিছু সুনির্দিষ্ট আচরণকে (তিনি বলতে চাইছেন) তুলে ধরা হয়েছে, তার এই সংশোধন বা সমাধানের কথা বলেছে।’ তিনি ডিলের ইঙ্গিত করেছেন। বলেছেন, ‘বহুমুখী পন্থায় কাজ’ করতে। ‘সুনির্দিষ্ট আচরণ’ যেগুলো নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে, ‘তার সংশোধন বা সমাধান করে’ নিতে বলেছেন আগে। অথচ আমরা উপরে দেখেছি সরকার হত্যা-গুম জাতীয় কাজে অভ্যস্ত বা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা ছাড়া সরকার চালানো বা টিকানো অসম্ভব। এ ছাড়াও এমনকি এক মারাত্মক ইঙ্গিতে তিনি বলেছেন, ‘এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকার কী- সেখানে বাংলাদেশকে ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে চীনের ব্যাপারে।’

বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকার কী- এটি নিয়ে আর তিনি কিছু খোলসা করেননি। কিন্তু আমেরিকা চাইছে কী?

এ নিয়ে যতটুকু জানা যাচ্ছে যেমন, কক্সবাজারে এয়ারপোর্ট রানওয়ে প্রকল্প যেটাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক যাত্রী ও কার্গো বিমানের ব্যবহার-উপযোগী করে গড়ে তোলার একটা প্রকল্প। বলা হয়েছে, এটিকে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের একটা হাব ও রিফুয়েলিং স্টেশন হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এতদূর পর্যন্ত এটা বাণিজ্যিক দিক থেকে এক উপস্থাপনই হলো। বিবিসি বাংলাতেও গত ২৮ আগস্ট ২০২১ এক প্রতিবেদনে এটাকে বাণিজ্যিকভাবেই দেখানো উপস্থাপন করা হয়েছে।

কিন্তু এখন দুর্জনরা বলছে, এই প্রকল্প চীনকে দেয়া হয়েছে এক স্ট্র্যাটেজিক (যুদ্ধকৌশলগত) কারণে। আর মালদ্বীপে চীনের যে জাহাজ চলাচলের অবজারভেটরি স্থাপনা আছে তার সাথে এটিকে সম্পর্কিত করে দেখতে হবে। অন্য দিকে এসবেরই পাল্টা বহুদিনের আমেরিকান এক আবদার হলো, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে তার সপ্তম নৌবহরকে স্থায়ী নোঙর করতে দিতে হবে। এটি ঘটার বিরুদ্ধে চীনের চেয়েও ভারত এই প্রশ্নে বেশি চরম কঠোর আমেরিকাবিরোধী। অথচ আমেরিকার এই খায়েশকেই সম্ভবত বিশ্লেষক প্রশান্ত পরমেশ্বরণ আমেরিকার ‘পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার কী- সেখানে বাংলাদেশকে ভূমিকা রাখতে হবে’ বলে অস্পষ্ট রেখে ছেড়ে রেখে দিয়েছেন! এসব ইঙ্গিত খুবই খারাপ ও বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর! কারণ এর অর্থ হবে সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির প্রশ্নটা শেষে না পিছলে গিয়ে তা আমাদের ভূখণ্ডকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে আমেরিকা-চীন ও ভারত তাদের নিজ নিজ স্বার্থের লড়াই শুরু করে দেয়!

অথচ বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থ হলো, যে অবস্থানে এলে এই তিন দেশকে নিউট্রাল রাখা যায়; কারণ আমরা কারো যুদ্ধের পাটাতন হতে পারি না।

কিন্তু সমীকরণ যে দিকেই মিলাই আমাদের হত্যা-নির্ভরশীল সরকার মনে হচ্ছে না কাউকে সাহায্য করতে পারবে; অর্থাৎ তার নিজের টিকে থাকা এই স্বার্থ, এটিই চতুর্থ ও মুখ্য স্বার্থ হিসেবে হাজির হতে চাইছে। অথচ বাস্তবতা হলো, হত্যা-নির্ভরশীল সরকার-প্রশাসন সাবেক আইজির কথিত নামকাওয়াস্তে কোনো সংস্কার করতেও অক্ষম থাকবে।

উভয় সঙ্কট
বর্তমান সরকার আসলে মারাত্মক উভয় সঙ্কটে। এখনকার উভয় সঙ্কট হলো, কোনো বিরোধী দলকে সে তাদের জনসমাবেশের অধিকার দিতে বাধ্য। কিন্তু যদি সরকারবিরোধীরা মিছিল সমাবেশ করতে চায় তাতেই সে কাত! সে ভীত যে, এটি না সরকারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। কারণ জমে থাকা পাবলিকের ক্ষোভ তাতে উপলক্ষ করে বের হয়ে যদি আসে! এ অবস্থায় সে যদি তাদের মিছিল-মিটিংয়ের অধিকার মেনে নেয় তো তাকে নিজ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে বাস করতে হবে। আর যদি উল্টা নির্বিচারে আগের মতো গুম-খুন ক্রসফায়ারে তা দমন করে চালাতে যায় তবে এটি আরো বড় মার্কিন অবরোধের কারণ হতে পারে। আর এর আগেই বাংলাদেশ হতে পারে এক রণভূমি!

পরিণতিতে কী হচ্ছে?
সেটাই কি কাওয়ালি হামলা! সরকার এখনো কার্ড দেখাতে পারেনি যে, তারা এ হামলার পক্ষে না বিপক্ষে? তাতে লাভ না ক্ষতি হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো, সরকারবিরোধী সবাই জোটবদ্ধ হয়ে কাওয়ালির পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রথম আলো-স্টার থেকে ছোট বা কড়া ইসলামিস্ট সবাই মিলে গেছে। অথচ এমন না যে, কাওয়ালি নিয়ে তাদের আপত্তি নেই; বরং অনেকেরই বড় বড় আপত্তি আছে। অথচ ক্ষমতার তাণ্ডবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ঐক্য দেখাতে তারা সেসব আপত্তি মাটি চাপা দিয়েছে। তারা জোটবদ্ধতা শো করতে চায় তাই। অবশ্য এমনটিই হয়ে থাকে। কমন এনিমি এই বড় শত্রুর বিরোধী বিরুদ্ধতা-জ্ঞান সবসময় এভাবেই কাজ করে!

আবার হামলাকারী যারা সঞ্জিত-সাদ্দাম গং, এদের পক্ষে কথিত প্রগতিশীলতার নামে হিন্দুত্ববাদের কোনো হাইকমিশনের পক্ষে কি তা হলে প্রকাশ্যে অবস্থান এখানে আমরা দেখে ফেললাম? নেত্রী কি এটাই চেয়েছেন? তা এখনো স্পষ্ট করা যায়নি! আবার ঘটনার তিন দিন পার হয়ে গেল কোনো অবস্থান না দেখানো সত্ত্বেও, তাহলে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, অন্যরা যা খুশি করছে ভাঙছে কি? সরকার কি তা হলে কর্তৃত্ব হারিয়েছে, এমন অনেক কথা উঠছে।

এমনিতেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর থেকে সরকার, অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এর ওপর আবার দলের ভেতরে ততোধিক যেন উপধারা বা উপস্বার্থের আবির্ভাব ঘটেছে। বেশির ভাগ নেতা কমপক্ষের দুটো স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছেন, ঘুরছেন। মুখে বলছেন একটি করছেন আরেকটি। এর মধ্যে আবার ‘আপার’ কোনটা অবস্থান বোঝা যাচ্ছে না। এর ‘আদর্শ প্রকাশ’ ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচনে। কে যে কার পক্ষে কাজ করছেন, তাল পাওয়া যাচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ রাতে ছাত্রলীগের নেতাদের বাসায় গিয়ে হুমকি দিচ্ছে কেন? নানক শামীম ওসমানকে হুমকি দিয়ে কথা বলছে…। ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

আরও খবর