রায়হান রাশেদ :
আসিয়া বিনতে মুজাহিম। প্রাচীন মিসরের ফেরাউনের (দ্বিতীয় রামেসিস, ফিরআউন) স্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন এক আল্লাহ বিশ্বাসী মহীয়সী নারী। ছিলেন মানুষের প্রতি দয়ালু ও সহানুভূতিশীল। তার স্বামী ফেরাউন নিজেকে স্রষ্টা বলে দাবি করত। সে ছিল অত্যাচারী ও বদমেজাজি বাদশাহ। অহংকার, দম্ভ ও অহমিকায় পরিপূর্ণ ছিল মসনদ।
সে সময় মানুষকে আল্লাহ বিশ্বাসী ও ফেরাউনের উদ্ধত অত্যাচার থেকে মুক্ত করার ব্রত নিয়ে পৃথিবীতে নবী মুসা (আ.) আগমন করেন। আল্লাহ মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। আল্লাহর আদেশে শিশু মুসার মা তাকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কাঠের সিন্দুকে ভরে নীল নদীতে ভাসিয়ে দেন। এই সিন্দুক ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়ার হস্তগত হয়। শিশু মুসার অপূর্ব সুন্দর চেহারা আসিয়ার মনে দাগ কাটে। মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে জেগে ওঠে। সে তাকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন।
পুত্রসন্তান দেখে ফেরাউন চটে যায়। কিন্তু স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের কাছে সে হেরে যায়। আসিয়ার কাছে রাজকীয় সুখানন্দে মুসা লালিত-পালিত হতে থাকেন। আসিয়া লাভ করেন মুসা (আ.)-এর পালকমাতা হওয়ার গৌরব। কোরআনে এসেছে—
ফেরাউনের স্ত্রী বলল, এ শিশু আমার ও তোমার চোখ শীতলকারী। তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। অথচ তারা উপলব্ধি করতে পারেনি।
(সুরা কাসাস, আয়াত : ৯)
আসিয়া ছিলেন ধনী পরিবারের মেয়ে। ভদ্র, শালীন, দয়ালু ও জ্ঞানী। ফেরাউনের স্ত্রী ছিলেন ঠিকই কিন্তু ফেরাউনের দুশ্চরিত্রের কোনো স্বভাব তাকে গ্রাস করতে পারেনি। অত্যাচারীর ঘরে থেকেও তিনি ছিলেন মানবতাবাদী ও মানুষের হিতৈষী। ছিলেন একজন নবীর পালকমাতা। এসব বিশেষ গুণই তাকে এক আল্লাহ বিশ্বাসী হতে সাহায্য করেছে। তিনি মুসা (আ.)-এর ধর্মগ্রহণ করেন। এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনেন। এদিকে ফেরাউন ছিলেন মুসা (আ.)-এর পরম শত্রু। নিজের স্ত্রী অন্যের উপাসনা করে— এমন খবর জানতে পেরে ফেরাউন স্ত্রীকে বোঝাতে থাকেন। নিজের বিশাল সাম্রাজ্য ও প্রজাদের কথা বলেন।
কিন্তু আসিয়া সত্য ধর্মের ওপর পাহাড়ের মতো অবিচল, অটল। ফেরাউন দেখল, কাজ হয় না। স্ত্রী ফিরে আসছে না তার দলে। সে বিশেষ লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে আসিয়াকে হত্যার আদেশ দেয়। ফেরাউনের সৈন্য-সামন্ত তার হাত-পা বেঁধে উত্তপ্ত সূর্যের নিচে ফেলে রাখে। অন্যদের চেয়ে কঠিন শাস্তি দেয় তাকে। দেহ রক্তাক্ত হয়। ক্ষতবিক্ষত হয় শরীর। তিনি ধৈর্যহারা হননি। ঈমান ছাড়েননি। জীবনের বিনিময়ে ঈমানকে রক্ষা করেন। দুনিয়ার রাজপ্রাসাদের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন জান্নাতে আল্লাহর পাশে একটি ঘর। আল্লাহর প্রতিবেশী হওয়ার আকুলতা ব্যক্ত করেন। তার প্রার্থনার কথা কোরআনে বাঙময় হয়েছে এভাবে—‘হে আমার প্রতিপালক! আমার জন্য আপনার কাছে জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করুন।
আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন। আমাকে মুক্তি দিন অত্যাচারী সম্প্রদায় থেকে।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত : ১১)
আল্লাহ আসিয়াকে সম্মানিত করেছেন। তার প্রতি খুশি হয়েছেন। কোরআনে তার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। পরবর্তী জাতির জন্য তার জীবনে শিক্ষা রেখেছেন। জান্নাতে যাওয়ার পাথেয় রেখেছেন। মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে তার সম্পর্কে উত্তম ধারণা দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পুরুষদের মধ্যে অনেকে পুণ্য অর্জন করেছেন। তবে নারীদের মধ্যে পুণ্য অর্জন করেছেন শুধু মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া…।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪১১)
জান্নাতবাসী নারীদের মধ্যে আসিয়া শ্রেষ্ঠ নারীর একজন। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) জমিনে চারটি রেখা টেনে বলেন, তোমরা কি জানো এটা কী? সাহাবারা বলেন, আল্লাহ ও তার রাসুল জানেন। রাসুল (সা.) বলেন, জান্নাতবাসীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নারী হলেন— খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৯০৩)
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-