রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার উপস্থিতি: জানে সবাই, কথা বলতে ভয়

ডেইলি স্টার •

কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পই সীমান্তে সংগঠিত চোরাচালান অপরাধ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যার পেছনে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি (আরসা) আছে বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গা ও গোয়েন্দা সূত্। আইনের শিথিল প্রয়োগ ও উদ্বাস্তুদের দুর্দশাকে পুঁজি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করছে।

গত অক্টোবরে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ এবং ৬ রোহিঙ্গা নাগরিককে হত্যার পর, আরসা তাদের অবস্থান আরও শক্ত করেছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে শিবিরের বাসিন্দারা এটা তাদের কপালে আছে বলেই ধরে নিয়েছে। ভয় ও দুর্দশা শিগগির তাদের পিছু ছাড়ছে না।

মুহিব উল্লাহর ভাই হাবিব উল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আরসা কর্মীরা ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত। রাতের বেলায় পুরো ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। রোহিঙ্গারা তাদের চেনে কিন্তু তারা প্রকাশ্যে কিছু বলতে ভয় পায়।’

ক্যাম্পের বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ জানান, মাদকপাচার থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, ত্রাণ সামগ্রী মজুদ করা সবকিছুই আরসার নিয়ন্ত্রণে। ‘তাদের মোকাবিলা করার মতো কেউ নেই এবং তারা রোহিঙ্গা শিবিরে শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে।’

তবে সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময়ই বলে আসছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। কিছু অপরাধী রোহিঙ্গাদের ভয় দেখানোর জন্য নিজেদের আরসা কর্মী হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে থাকতে পারে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি অংশে আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ১৪তম আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কমান্ডার নাইমুল হক বলেন, ‘ক্যাম্পে আরসার কোনো উপস্থিতি নেই। যারা এইসব বলে তাদের চিহ্নিত করা উচিত। এটি একটি ডাহা মিথ্যাচার। রোহিঙ্গাদের অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হচ্ছে।’

রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা ও ত্রাণ সামগ্রী গ্রহণের জন্য ক্যাম্পের বাইরে যেতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাদের কেউ কেউ এই সুযোগে মাদক ব্যবসায় লিপ্ত। এমনকি তাদের পেট থেকেও আমরা ইয়াবা উদ্ধার করেছি।’

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের স্বার্থে সরকারি কর্মকর্তারা কক্সবাজারে আরসার অস্তিত্ব অস্বীকার করে থাকতে পারেন। ‘আমি যতদূর জানি, মিয়ানমার বলেছে যে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক সন্ত্রাসী আছে এবং তাদের তারা দেশে ফিরিয়ে নিতে চায় না। কিন্তু বাংলাদেশ বলছে, ক্যাম্পগুলোতে কোনো আরসা সদস্য নেই।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে কাজ করা বহিরাগত শক্তি বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন করছে।’

রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পুলিশ পোস্টে হামলার দায় স্বীকার করে আরসা। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সেই ঘটনার অযুহাতে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক দমন পীড়ন চালায়। যার ফলে এই অঞ্চলে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সংকট দেখা দিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের অনেকে মনে করে, আরসা সদস্যরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চায় এবং আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবাসন আলোচনায় একটি পক্ষ হতে চায়। তাদের অস্থানের একটি শক্ত বার্তা দিতে তারা মুহিব উল্লাহ এবং অন্য ৬ জনকে হত্যা করেছে।

মাদক ও মানবপাচারের পাশাপাশি, আরসা সদস্যদের অর্থের একটি প্রধান উৎস চাঁদাবাজি।

প্রতি সপ্তাহে প্রায় দেড় হাজার দোকান তাদের টাকা দেয়। রোহিঙ্গা সূত্র জানায়, ক্যাম্পে প্রায় ৫০০ মাদ্রাসা আছে। বেশিরভাগ মাদ্রাসা আরসার একটি সহযোগী সংস্থা উলামা কাউন্সিল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

অন্য প্রভাবশালী দলটি ইসলামি মহাস। যা মুহিব উল্লাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল।

ইসলামি মহাস সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এবং প্রত্যাবাসনের পক্ষে। অন্যদিকে উলামা কাউন্সিল মাদক ও মানব পাচার নিয়ন্ত্রণ করে।

এপিবিএন কর্মকর্তারা জানান, মুহিব উল্লাহকে হত্যার পর থেকে ফৌজদারি অভিযোগে আড়াই শতাধিক রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ১১৪ জন আরসা সদস্য বলে দাবি করেছে।

এই প্রতিবেদক গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা এবং তাদের সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরসা সম্পর্কে কথা বলেছেন। কারণ তারা ভয় পান যে, তাদের নাম জানতে পারলে আরসা এর প্রতিশোধ নেবে।

তারা বলেন, বিপুল সংখ্যক আরসা সদস্য মিয়ানমারের এজেন্ট এবং তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী থেকে নিয়মিত নানা সুযোগ-সুবিধা পান।

এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘আরসা কর্মীরা মিয়ানমার প্রশাসনের এজেন্ট হিসেবে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে কাজ করছে।’

বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, আরসা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের অধিকারের জন্য লড়াই করার দাবি করেছিলেন এবং অনেক সাধারণ মানুষ প্রাথমিকভাবে তাদের বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু এখন রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করেন, আরসা মিয়ানমার সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে এবং তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে বাধা দিচ্ছে।

আরেক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘পরিস্থিতি এতটাই ভীতিকর যে আমরা আমাদের বাড়িতে ফিরতে চাই এটা প্রকাশ্যে বলতে পারি না। যারা প্রত্যাবাসনের কথা বলছেন তাদের হত্যা করা হচ্ছে।’

২০১৭ সাল থেকে মুহিব উল্লাহ, আরিফ উল্লাহ, আবদুর রহিম, নূরে আলম, হামিদ উল্লাহর মতো জনপ্রিয় নেতাসহ আরও ৫০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত নেতাদের পরিবারের সদস্যরা জীবনের ভয়ে আত্মগোপনে আছেন।

বালুখালী ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা ব্যক্তি বলেন, ‘আরসা মিয়ানমার সরকারের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা এই নাটক মঞ্চস্থ করে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। এখন তারা প্রত্যাবাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘সমস্যাটি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূত এবং মাদক চোরাচালান, ছোট অস্ত্র চোরাচালান এবং মানব পাচারে অপরাধীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক আছে।’

আরসা কী?

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে কাজ করে আরসা। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় আসে। সেসময় সংগঠনটি মিয়ানমারের মংডু এবং রাথেডাং শহরে তিনটি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা করে ৯ জন কর্মকর্তাকে হত্যা করে।

বিবিসির তথ্য মতে, আরসা নেতা আতাউল্লাহ আবু ওমর জুনুনি হামলার দায় স্বীকার করে জানান ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর বিভিন্ন অপরাধ ও নৃশংসতা চলছে।

তিনি জানান, আরসা একটি বার্তা দিতে এই হামলা চালিয়েছে। বার্তাটি হলো সহিংসতা বন্ধ না হলে তারা আত্মরক্ষা করার অধিকার রাখে। এতে বলা হয়, তারা নাগরিকত্বসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার পক্ষে লড়াই করছে।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলেছে যে, আরসা সদস্যরা মুসলিম সন্ত্রাসী। তারা ইসলামি শাসন কায়েম করতে চায়।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) ২০১৬ সালে এক প্রতিবেদনে বলেছে, সৌদি আরবে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বে এই গ্রুপের নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে। আইসিজি বলছে আরসা নেতা আতাউল্লাহ, পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সৌদি আরবে বেড়ে উঠেছেন।

আতাউল্লাহর অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করেন যে, তিনি আরাকানে থাকেন এবং সেখান থেকে তিনি তার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমার মতামত হলো আরসা বরাবরই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জন্য কাজ করে আসছে। আমি এটি বেশ কয়েকবার প্রকাশও করেছি। আমি মনে করি, অস্বীকার করার পরিবর্তে বাংলাদেশের এই লাইন ধরে কথা বলা উচিত।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, ‘আরসা একটি সন্দেহজনক সংগঠন। তারা যে মতাদর্শ ধারণ করেন তার চেয়ে বেশি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।’

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে সমর্থন করে না এমন বহিরাগত শক্তির সমর্থনে এটি একটি রোহিঙ্গা ব্র্যান্ড হিসাবে নিজেকে রূপান্তরিত করেছে। শুধু নতুন একটি আবির্ভূত শক্তি মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী তাতমাডওয়কে রোহিঙ্গাদের নির্মূলে উৎসাহ দিয়েছে এটি হতে পারে না। এটা একটা কমন বিষয়।’

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করা অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, ‘মিয়ানমারের বর্ণনায় এই সন্দেহজনক গোষ্ঠীটিকে চরমপন্থী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা অব্যাহত আছে। অনেকে এই ফাঁদে পড়ে আরসাকে রোহিঙ্গাদের আদর্শিক প্রতিনিধি হিসেবে মনে করেন।’

তিনি বলেন, ‘তাতমাডওয় একটি ইসলাম ভীতি পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছিল, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো মধ্যে যার একটি বড় আবেদন আছে। এভাবে আরসা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে তাদের মতাদর্শ বিস্তারের মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করবে।’

আইআরের এই অধ্যাপক বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের একটি খুব ছোট অংশ অজ্ঞতাবশত আরসার কার্যক্রমকে সমর্থন করতে পারে, তবে এটিকে একটি সাধারণ ঘটনা হিসাবে দেখা উচিত নয়।

আরও খবর