ইত্তেফাকের সৌজন্যে...

ইউপি নির্বাচন: নৌকার ভরাডুবির কারণ কী

চলতি বছরের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ দলীয় প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। আর এসব ইউনিয়নে জয়ী হয়েছেন খোদ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।

নির্বাচন শেষে দলীয় প্রার্থীর ‘ভরাডুবি’ নিয়ে বিশ্লেষণে বসেছেন স্থানীয় থেকে শুরু করে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারাও। তারা নৌকার ভরাডুবির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।

শরীয়তপুর প্রতিনিধি অনল কুমার দে জানান, সদর উপজেলার ৯ ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৫ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। তাদের পরাজয়ের পেছনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন পরাজিতরা। এছাড়া তারা ওই ইউনিয়নগুলোতে পুনরায় নির্বাচন দাবিও করছেন।

তারা ১৩ নভেম্বর দুপুরে শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অভিযোগ তুলে ধরেন। পরাজিত এই ৫ চেয়ারম্যান প্রার্থী হলেন, আংগারিয়া ইউনিয়নের আসমা আক্তার, মাহমুদপুরে লিয়াকত হোসেন, ডোমসারে মিজান মোহাম্মদ খান, শৌলপাড়ার মো.আলমগীর হোসেন ও পালং ইউপির আবুল হোসেন দেওয়ান।

সংবাদ সম্মেলনে আসমা, মিজান, আবুল হোসেন, আলমগীর, লিয়াকত অভিযোগ করে বক্তব্যে বলেন,‘প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সাংসদ, জেলা আওয়ামী লীগের মাধ্যমে আমরা দলীয় প্রতীক নৌকা পেয়েছি। ১১ নভেম্বর ইউপিগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

ডোমসার ইউনিয়নে বাড়ি শরীয়তপুর পৌরসভার মেয়র পারভেজ রহমান জন ও সাবেক মেয়র, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম কোতোয়াল, তার ভাই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম কোতোয়াল নৌকার বিপক্ষে, বিদ্রোহী প্রার্থী মাস্টার মজিবুর রহমান খানের (আনারস) পক্ষে কাজ করেন। এছাড়া আংগারিয়া ইউনিয়নে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুর রব মুন্সী ও তার ছেলে পাবেল মুন্সীসহ লোকজন আওয়ামী লীগ নৌকা প্রার্থী আসমা আক্তারের বিপক্ষে, বিদ্রোহী প্রার্থী আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের পক্ষে কাজ করেন। শৌলপাড়া ইউনিয়নে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল আলিম আওয়ামী লীগ নৌকা প্রার্থী আলমগীর হোসেন খানের বিপক্ষে, বিদ্রোহী প্রার্থী এসকান্দারের (ঘোড়া) পক্ষে কাজ করেছে। যা দুঃখজনক।’

এই নেতারা আরও বলেন, ‘নির্বাচনে পুলিশ প্রশাসন বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। নৌকার ব্যাজ পরা দেখলেই ধাওয়া দেয়। পুলিশ প্রশাসন নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছে। বিদ্রোহী প্রার্থী ও পুলিশের লোকেরা আমাদের লোক আটকে রেখে ভোট কারচুপি করেছে। এছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থীর লোকজন বোমা মেরে নৌকার ক্লাব ভাঙচুর, আমাদের সমর্থকদের মারধর, ঘর ভাঙচুর করে লুটপাট করে। এতে আমাদের লোক আহত হয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থীর লোকজন প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে। আমরা মামলা করতে গেলে মামলা নিচ্ছে না পুলিশ।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘যারা নৌকা মনোনয়ন পাননি, তারা অভিমান করে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন। আবার দেখা গেছে, তাদেরই কেউ কেউ বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে গিয়ে কাজ করছেন। এসব কারণেই মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই পরাজিত হয়েছেন। আমরা চেষ্টা করেছি নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে আওয়ামী লীগের অন্য কেউ বিদ্রোহী হিসেবে কেউ না দাঁড়ায়। অনেকাংশে সফল হয়েছি, তবে কিছু কিছু জায়গায় ব্যত্যয়ও ঘটেছে।’

দলীয় প্রতীক পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের অসহযোগিতায় দলের মনোনীত প্রার্থীদের পরাজিত হওয়ার প্রসঙ্গে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘দলের প্রার্থী যখন থাকে, সেখানে দলের নেতা-কর্মীরা মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন, এইটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সুদিনে ও দুর্দিনে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে আসছে দলের জন্য। সেই নেতারাই যখন দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কাজ করেন, তখন বিষয়টি অবশ্যই বেদনাদায়ক। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক আমি চাই না।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস. এম. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা চাই নির্বাচনটা উৎসবমুখর পরিবেশে হোক। বাস্তব সত্য হলো, রাজনীতিতে বিরোধিতা করার জন্য বিরোধিতা নয়। কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, এছাড়া প্রাণহানিও ঘটেছে বিষয়টি দুঃখজনক। সারাদেশে ৮৩৫টি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে ৫ থেকে ১০টি ইউপিতে সংঘাত হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থী জেতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নৌকার প্রার্থীর পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থীরও জনপ্রিয়তা রয়েছে। সেই বিদ্রোহী প্রার্থী স্থানীয় আওয়ামী লীগের তার সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে সে বিজয়ী হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখা গেছে তৃণমূলে নৌকা বা আওয়ামী লীগকে যারা পছন্দ করে না কিংবা যারা বিএনপি-জামায়াত করে, তাদের ভোট এই বিদ্রোহী প্রার্থীদের কোটায় চলে যাচ্ছে। নৌকার জন্ম থেকেই একটি অংশ এর বিপক্ষে রয়েছে। তারাই মূলত বিদ্রোহীকে সাপোর্ট দিয়ে নৌকাকে হারাচ্ছেন। তবে, দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নৌকার বিদ্রোহীরা আর কখনো ভবিষ্যতে দলীয় প্রতীক পাবে না।’

দলীয় প্রতীক পাওয়ার পরও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের অসহযোগিতায় দলের মনোনীত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে দলের এই সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ‘অনেক জায়গায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা, জেলা-উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ স্থানীয় সংসদ সদস্যরা গোপনে তাদের সাপোর্ট দিয়েছে। এমন অনেক রিপোর্ট আমাদের কাছে এসেছে। আমরা এগুলো তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে সামনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এইগুলো উপস্থাপন করবো। এরপর নীতিনির্ধারকেরা সিদ্ধান্ত নেবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা মিথ্যা কথা নয় যে, আওয়ামী লীগের ভেতরেই একটা অংশ বিদ্রোহীদের মদদ দিচ্ছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে। এরকম আছে, আমাদের কাছে তথ্য আছে, তবে সেইগুলো তদন্ত সাপেক্ষে। সরাসরি না দিয়েও পরোক্ষভাবে দিচ্ছে। যার ফলে এমনটা হচ্ছে।’

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনে নৌকার বিদ্রোহীদের পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি, দলীয় প্রার্থীদের পাশে না থাকায় এমনটা হয়েছে। তবে আমরা অভিযোগ আমলে নিয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।’

সদর উপজেলা আওযামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় প্রার্থীদের পাশে না থাকায় পাঁচটি ইউপিতে দলের প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ কেন দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

আরও খবর