আরসাকে পেছন থেকে মদদ দিচ্ছে মিয়ানমার, আতঙ্কে রোহিঙ্গারা

বিশেষ প্রতিবেদক •

মিয়ানমারকেন্দ্রিক সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) ঘিরে সন্দেহ বাড়ছে রোহিঙ্গাদের। তারা মনে করছে, আরসাকে পেছন থেকে মদদ দিচ্ছে মিয়ানমারের প্রশাসন।

দেশটির ‘গোপন এজেন্ট’ হিসেবে প্রত্যাবাসনবিরোধী কাজ করছে সংগঠনটি। গত এক মাসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে রক্তপাতের ঘটনা ঘটে, এর পেছনেও আরসার হাত রয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।

কয়েকটি আশ্রয় শিবিরে বিভিন্ন পর্যায়ের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আরসা এখন তাদের কাছে ভয় ও আতঙ্কের নাম। তাদের অভিযোগ, ক্যাম্পে হামলা, একের পর এক খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ নানা অপরাধে জড়িত এই সংগঠন। এরা আল ইয়াকিন বা আলেখিন নামে পরিচিত। উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা তাদের কাছে জিম্মি।

২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা করে আরসা। এরপর রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এ সময় আরসা দাবি করেছিল, তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে লড়াই করছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে বিশ্বাসও করেছিল তাদের এই দাবি। তবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অনেক রোহিঙ্গার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তবে কেউ পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি নন ভয়ে। তারা বলছেন, প্রাণ বাঁচাতে তারা পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। এখানে এসেও বাঁচতে পারছেন না। আলেখিনের হাতে হত্যার শিকার হতে হচ্ছে।

তাদের ভাষ্য, তারা নিজ দেশে ফিরে যাবেন- এই কথাও প্রকাশ্যে বলতে পারেন না। কেউ নিজ দেশে ফিরে যাবেন বললে তাকে হত্যা করা হয়। প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলায় মাস্টার মুহিবুল্লাহ, মাস্টার আরিফ উল্লাহ, আবদুর রহিম, নুর আলম, হামিদুল্লাহ, মৌলভী হাসেম, মো. নুরসহ অর্ধশত রোহিঙ্গা নেতাকে তারা হত্যা করেছে। জনপ্রিয় এসব নেতার স্বজনরাও এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

সম্প্রতি হামলায় নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)’ নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠন নিয়ে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছিলেন তিনি। হত্যাকাণ্ডের পর তার স্বজনরাসহ সংগঠনটির অর্ধশত নেতারা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

এআরএসপিএইচের দ্বিতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা রশিদ উল্লাহ অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোনে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আরসা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তৈরি একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। মিয়ানমারে সেনা ক্যাম্পে হামলার নাটক সাজিয়ে তারা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা এখন এই সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে জিম্মি। কেউ প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বললেই তাদের হাতে খুন হচ্ছে।

রশিদ উল্লাহ বলেন, সন্ত্রাসী এই গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে আতা উল্লাহ, ওস্তাদ হাসিম, ওস্তাদ খালেদ, জকির, শফি, মো. আজিজ ওরফে অলি, জাবের, খালেক ওরফে হোসেন, আবদুল মালেক, মৌলভী আকিজ, ফজল কবির ওরফে আবু আনাসসহ কয়েকজন। তারা অস্ত্র ব্যবসা, মাদক পাচার, অপহরণ করে অর্থ আদায়সহ নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের জড়িত করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে।

অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোনে কথা বলেন নিহত মুহিবুল্লাহর ভাই হাবিবুল্লাহও। তিনি বলেন, আলেখিন নামে সন্ত্রাসী বাহিনী পুরো ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। এখানে অন্য কেউ নেতা হোক, তারা চায় না। এ কারণেই জনপ্রিয় নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে তারা। হত্যার আগে সতর্ক করে হুমকি ধমকি দিয়েছিল।

তিনি বলেন, মুহিবুল্লাহ এবং ছয় রোহিঙ্গা হত্যায় যারা অংশ নিয়েছে, তারা সবাই আলেখিনের লোক। তাদের প্রায় সবাইকে আমরা চিনি।

হাবিবুল্লাহ জানান, হত্যাকাণ্ডের পর সন্ত্রাসীরা মোবাইল ফোনে মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠজনদের হুমকি দিচ্ছে। এ নিয়ে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই এখন অজ্ঞাত স্থানে রয়েছেন।

এআরএসপিএইচের আরেক নেতা মাস্টার আবদুর রহিম বলেন, সন্ধ্যার পর কী ঘটবে, তা নিয়ে অজানা আতঙ্কে থাকেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।

মুহিবুল্লাহ হত্যায় আটক হয়েছে আজিজুল হক নামে এক রোহিঙ্গা। মুহিবুল্লাহ হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে এই ব্যক্তি। বলেছে, আলেখিনের শীর্ষ নেতার নির্দেশে তারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর আগে আটক মোহাম্মদ ইলিয়াছ নামে এক রোহিঙ্গাও একই ধরনের স্বীকারোক্তি দিয়েছে আদালতে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক বলেন, মাস্টার মুহিবুল্লাহকে হত্যার আগে দুর্বৃত্তরা লম্বাশিয়া মরকজ পাহাড়ে দুই দফা মিটিং করেছে। মিটিংয়ে আজিজুল হকসহ আরও চারজন উপস্থিত ছিল। আজিজুল স্বীকার করেছে, শীর্ষ নেতার নির্দেশে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে তারা। কারণ মাস্টার মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের বড় নেতা হয়ে গিয়েছিলেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আরসার প্রধান আতা উল্লাহ। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাকিস্তানের করাচিতে, পড়ালেখা সৌদি আরবে। ২০১২ সালে সৌদি আরব থেকে তিনি হঠাৎ ‘অদৃশ্য’ হয়ে যান। এরপর আরসার আমির পরিচয়ে ২০১৭ সালের আগস্টে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন মিয়ানমারের রাখাইনে। বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেটে অডিও-ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আতা উল্লাহ দাবি করেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার আদায়ে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। তবে ২০১৭ সালের ২৪ আগস্টের পর তেমন কোনো লড়াইয়ের খবর আর পাওয়া যায়নি।

আরও খবর