মুহিবুল্লাহ হত্যা: তিন মিনিটে শেষ হয় কিলিং মিশন

আবদুর রহমান •

তিন-চার মিনিট পর পরই মাথায় টুপি ও মুখে মাস্ক পরে সাত থেকে আটজন অস্ত্রধারী মুহিবুল্লাহর অফিসে ঢুকে পড়ে। তারা জানতে চায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠাতে ক্যাম্পের ভেতর প্রতিটি ব্লকে সাত সদস্যের গ্রুপ কে তৈরি করেছে। এরপর তারা মুহিবুল্লাহর মাথায় অস্ত্র তাক করে। পরে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়।’ এভাবেই মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন সেদিন ঘটনাস্থলে থাকা এক রোহিঙ্গা দিনমজুর।

শরণার্থী শিবিরের ভেতর নিজ সংগঠনের কার্যালয়ে গত বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাতে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ (৫০)।

ঘটনাস্থলে থাকা চল্লিশ বছর বয়সী ওই রোহিঙ্গা দিনমজুর জানান, অজ্ঞাত পরিচয়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মাত্র কয়েক মিনিটেই হত্যা করে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচআর) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে। ওই রাতে ১০-১২ জন শরণার্থীর সঙ্গে মুহিবুল্লাহ তার অফিসে ত্রাণের সংকট, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে কথা বলছিলেন। এমন সময় তিনি ওইখানে উপস্থিত হন বলে জানান ওই প্রত্যক্ষদর্শী।

ওই রোহিঙ্গা দিনমুজর বলেন, ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার তিন-চার মিনিট পর পরই মাথায় টুপি ও মুখে মাস্ক পরে সাত থেকে আটজন অস্ত্রধারী ওই অফিসে ঢুকে পড়ে। তারা জানতে চায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠাতে ক্যাম্পের ভেতর প্রতিটি ব্লকে সাত সদস্যের গ্রুপ কে তৈরি করেছে? এ কথার বলার পর পরই মুহিবুল্লাহর মাথার ওপর অস্ত্র তাক করে নড়াচড়া না করতে বলে সন্ত্রাসীরা। এসময় আমাকে মাথা নিচের দিকে করে মাটিতে শুয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, ‘আমি শুয়ে পড়তেই একজন মুহিবুল্লাহর বুকে তিনটি গুলি করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মুহিবুল্লাহ মাটিতে পড়ে যান। এ সময় অফিসে থাকা অন্যরা পালিয়ে যান। গুলি খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মুহিবুল্লাহ দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে এক সন্ত্রাসী ফিরে এসে তার বুকে ও চোখে আরও দুটি গুলি করে। এরপর আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।’

সন্ত্রাসীদের সবার পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও টি-শার্ট এবং মুখে মাস্ক ছিল। সবার হাতেই ছিল পিস্তল, জানান তিনি।

‘মুহিবুল্লাহর মৃত্যুর পর আমরা সবাই ভয়ে আছি, রাত হলে চোখে ঘুম আসে না। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে জীবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাচ্ছি,’ যোগ করেন ওই প্রত্যক্ষদর্শী।

মুহিবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন স্বেচ্ছাসেবী জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তা করার জন্য ব্লক-ভিত্তিক সাত সদস্যের কমিটিগুলোকে সংস্কারের কাজে সম্প্রতি হাত দিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। গত পাঁচ মাস ধরে তিনি সক্রিয়ভাবে এই কাজটি করছিলেন।

এদিকে হত্যার পাঁচ দিন পার হলেও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিল এমন কাউকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। তবে সন্দেহভাজন পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তদন্ত-সংশ্নিষ্টদের ধারণা, খুনিরা ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে।

(নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শীর নাম ও ছবি প্রকাশ করা হলো না)

সরেজমিনে কক্সবাজারের উখিয়ার প্রধান সড়ক থেকে এক কিলোমিটার ভেতরে লম্বাশিয়া ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ নামের সংগঠনের কার্যালয়ের পাশে একটি ঝুপড়ি ঘরের দরজার সামনে একজন এসআইয়ের নেতৃত্বে এক দল এপিবিএন সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। আর ঘরের ভেতরে অবস্থান করছেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর স্ত্রী, সন্তান ও তার স্বজনরা।

সেখানে কথা হয় মুহিবুল্লাহর ছোটভাই হাবিব উল্লাহর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমরা খুব বেশি ভালো নেই। কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই। কিন্তু একটি কথা পরিষ্কার বলতে চাই- আমরা এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামিদের কঠিন শাস্তি চাই।’

মুহিবুল্লাহর ভাগ্নে রশিদ উল্লাহ বললেন, ‘এসব বিষয়ে লিখে আর কী হবে? আমার মামাকে যারা আগে থেকে হুমকি দিয়ে আসছিল, তারাই হত্যা করেছে। ক্যাম্পের অনেকে বিষয়টি জানেন। তাদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রকৃত হত্যাকারীদের নাম পাওয়া যাবে। হত্যার আগের দিন একটি গ্রুপ কেন এখানে আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল- সেটিও তদন্ত করা প্রয়োজন। এই অপরাধীদের শক্ত নেটওর্য়াক ভাঙতে বাংলাদেশ সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে এক এক করে সব শিক্ষিত রোহিঙ্গা নেতাদের শেষ করে দেওয়া হবে।’

হত্যার আগে রেকি
স্থানীয় কারও কারও ভাষ্য, ঘটনাস্থলে আগে থেকেই অবস্থান করছিল মোরশেদ ও আবদুর রহিম ওরফে রকিম, মোজাম্মেল ওরফে লাল বদিয়াসহ পাঁচ জন। এছাড়া সেদিন লম্বাশিয়ার ‘মরকজের পাহাড়’ এলাকায় মো. সিরাজ, সৈয়দ আলম, নুর সাবা মো. রফিক, খায়রুল আমিনসহ বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন গোপন আলোচনায় বসে। তখন তাদের স্বাভাবিক অবস্থা ছিল না বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের।

এ বিষয়ে আবুল বশর নামে এক রোহিঙ্গা জানান, ‘মরকজের পাহাড়ের বসবাসকারী এক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন বুধবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত বেশ কিছু মানুষ মাস্ক পরে সেখানে জড়ো হয়েছিল। আবার অনেকের মাথায় টুপিও ছিল। তাদের দেখে তার সন্দেহ হয়। কিন্তু ভয়ে কাউকে কিছু বলার সাহস পায়নি। কারণ তারা এখানকার রাজা বলে কথা।’

তিন মিনিটে কিলিং
বুধবার রাতে মুহিবুল্লাহ অফিসে থাকা দুই জন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আলোচনা শুরুর তিন-চার মিনিট পরই মুখোশ পরিহিত অবস্থায় ৭-৮ জন অস্ত্রধারী অফিসে প্রবেশ করে। তারা জানতে চায়- কেন ব্লকে ব্লকে টিম তৈরি করা হচ্ছে? মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে উদ্বুদ্ধ করতে ওই টিম তৈরি করা হয়- এটা বলামাত্রই মুহিবুল্লাহকে গুলি করা হয়। তাদের ধারণা প্রথমে আবদুর রহিম ওরফে রকিম তিনটি গুলি ছুড়ে তার বুকের দিকে। তিনি রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পরে যায়। পরে মোরশেদ এসে বুকে ও চোখে আরে দুটি গুলি করে। সব মিলিয়ে মোট তিন মিনিটের ভেতর পাঁচটি গুলি করে তারা সেখান থেকে এলোমেলোভাবে পালিয়ে যায়।

গুলি না লাগায় প্রাণে রক্ষা পান মুহিবুল্লাহর ভাই হাবিব উল্লাহ
সেদিন মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর পরই তিনি ছাড়া শুরুতে বাইরে গুলির শব্দ শুনে আর কেউ এগিয়ে আসেনি বলে জানিয়েছিলেন হাবিব উল্লাহ। তার ভাষ্য অনুযায়ী অফিসের পাশে বাড়ি হওয়ার সুযোগে বিকট শব্দ শুনে এগিয়ে আসলে পালানোর চেষ্টাকালে হামলাকারীদের মধ্য একজনকে ধরে ফেলি। কিন্তু সে-সময় ধস্তাধস্তি দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে দুটি গুলি করেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে গুলি তার গায়ে না লাগায় প্রাণে বাঁচেন তিনি।

এ বিষয়ে মুহিবুল্লাহ ভাগ্নে রশিদ উল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর রহমত রয়েছে না হলে দুই ভাইকে একসঙ্গে হত্যা করা হতো। গুলির শব্দ শুনে ছোট মামা হাবিব উল্লাহ দৌড়ে আসার সময় এক হামলাকারীকে ধরে ফেলে। এ সময় ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে দুই রাউন্ড গুলি চালানো হয়। ভাগ্যক্রমে একটি গুলিও ছোট মামার গায়ে লাগেনি। তবে দুঃখজনক বিষয় আমাদের আসল সম্পদ (মুহিব উল্লাহকে) রক্ষা পায়নি।’

এদিকে হত্যার অংশ নেওয়ার আগে এখানে অভিযান চলবে এমন প্রচারণা চালিয়ে মুহিবুল্লাহ কার্যালয়ের কাছকাছি দোকান ও ঘরবাড়িগুলোতে থাকা লোকজনকে চলাচল বন্ধ করতে বলা হয়। অনেকে সেদিন আগে আগেই দোকানপাট বন্ধ করে ফেলেন। এর ১০ মিনিট পর সেখানে হই চই শুরু হয়।

মো. মকতুল নামে এক দোকানি জানান, রাত ৮ টার পরে ওখানে অভিযানের কথা বলে হাফ প্যান্ট পরা কিছু মানুষ দোনপাট ও ঘরবাড়ি বন্ধ করতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই খবর আসে মুহিবুল্লাহকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ সময় ওই লোকগুলোকে দৌড়ে ও হেঁটে যেতে দেখা গেছে। তার মধ্য দু’জনকে চেনা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যারা বেআইনি কাজে জড়িত, এমন বেশ কিছু গ্রুপের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কে-কী ধরনের অপরাধে জড়িত তা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া যারা নিয়মিত গোপনে ক্যাম্পের বাইরে যাতায়াত করছে, তাদের ওপরেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, মামলাটি পুলিশ খুব গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। ইতোমধ্যে রিমান্ড মঞ্জুর হওয়া দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এ সব বলা যাচ্ছে না।

এদিকে নিরাপত্তার অভাবে মুহিবুল্লাহ হত্যার বিচারের দাবিতে কোনও আন্দোলন সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং বলেন, ‘যেভাবে মামলার তদন্ত এগোচ্ছে, তাতে ন্যায় বিচারের আশা দেখছি না। আমরা স্বচ্ছ ও আইনি প্রক্রিয়ায় প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

তিনি আরও জানান, সাধারণত আগে রাতের বেলায় শরণার্থী শিবিরে অনেক লোক চলাচল করতো। তবে মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে লোক চলাচল কমে গেছে। লোকজন ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। রাত হলে এখানে খুব বেশি ভয় লাগে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে একদল অস্ত্রধারী। তিনি ছিলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ নামে রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর এলাকার স্কুলশিক্ষক মুহিবুল্লাহ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

আরও খবর